এর আগে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে দশটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। তাদের মতে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্যান্য অনেক খাতে সংস্কার ও পরিবর্তন আসলেও, পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণ খাত এখনও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রস্তাবিত ৪০ কোটি বইয়ের ৮০ শতাংশ মুদ্রণের কাজ এই দশটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সময়মতো বই মুদ্রণ ও সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এর মধ্যে রাজধানীর একটি আস্তানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ যুবলীগ নেতা জহুরুলের ম্যানেজার এবং হিসাবরক্ষকসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় গতকাল রোববার তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একাধিক সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ শেষ করার জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় চাওয়া এবং প্রতি দফায় তিনটি বই ছাপার অগ্রিম বিলসহ বিভ্রান্তিকর দাবি তুলে মুদ্রণ শিল্প সমিতি শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে আবেদন করেছিল। এই বিষয়টি নিয়ে গতকাল রোববার তীব্র আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
সকালে আবেদন জমা দেওয়ার পর রাতেই সমিতি ক্ষমা চেয়ে আবেদনটি প্রত্যাহার করে নেয়। তারা একটি মুচলেকা দেয় যে, সময়মতো বই মুদ্রণের কাজ সম্পন্ন করা হবে। এ বিষয়ে সমিতির সভাপতি মো. রব্বানী জব্বার দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, কে বা কারা সমিতির প্যাড ব্যবহার করে এমন আবেদন করেছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সমিতির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সহ-সভাপতি জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ এই আবেদন সই করে জমা দিয়েছিলেন, যা তিনি স্বীকার করেছেন। সভাপতি রব্বানী জব্বার বিষয়টি জানার পর মুচলেকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
রোববার রাতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কার্যালয়ে সকল কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে মুদ্রণ শিল্প সমিতি তাদের মুচলেকা দিয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে দেওয়া চিঠিতে তারা প্রস্তাব করেছিলেন, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে মাত্র তিনটি বই সরবরাহ, ৫ মার্চের মধ্যে ৮০ শতাংশ বই এবং বাকি বই ২৫ মার্চের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। তবে এই প্রস্তাব ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর ফলেই তারা মুচলেকা দিতে বাধ্য হন, যেখানে সময়মতো বই মুদ্রণ ও সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনিয়মের অভিযোগে দশটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। তাদের ধারণা, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্যান্য অনেক খাতে সংস্কার ও পরিবর্তন এলেও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণ খাত এখনও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য নির্ধারিত ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ মুদ্রণের কাজ পেয়েছে এই দশটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, পরিকল্পিতভাবে সময়মতো বই মুদ্রণ ও সরবরাহ ব্যাহত করতে অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়েছে।
এরই মধ্যে রাজধানীর একটি আস্তানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ যুবলীগ নেতা জহুরুলের ম্যানেজার ও হিসাবরক্ষকসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় গতকাল রোববার তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একাধিক সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত সপ্তাহে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে অন্তত তিনটি আবশ্যিক বই তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তবে জানা গেছে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মুদ্রণ ও কাগজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে নির্দেশনা এড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে ব্যাংকের ঋণ ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-কে দোষারোপ করার কৌশল গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, প্রাথমিক পর্যায়ের বই বিতরণে কোনো সমস্যা নেই বলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা এবং সংশ্লিষ্ট মুদ্রাকররা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই প্রাথমিকের সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে, একাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মায়া চৌধুরীর ভাগ্নে পাঁচটি প্রধান মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের একটি পরিচালনা করেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এনসিটিবির সাবেক এক সচিবকে ডলারে ঘুষ দিতেন, যার সন্তান বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছেন। মায়া চৌধুরীর ভাগ্নেকেই এই অনিয়মের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
সম্প্রতি তিনি ২২০ গ্রামের প্রায় ৪০০ মেট্রিক টন আর্ট কার্ড (বইয়ের প্রচ্ছদ মুদ্রণের জন্য) আমদানি করেছেন, যা এনসিটিবির টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী ২৩০ গ্রাম হওয়া বাধ্যতামূলক। এটি টেন্ডারের শর্ত লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মাস্টার সিমেক্স, সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, কুচয়া প্রিন্টিং, সরকার প্রেস, বলাকা প্রেস, অন্যন্যা প্রেস, ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেস, সীমান্ত প্রেস, প্রমা প্রেস, রূপালী প্রিন্টিং প্রেস, আনন্দ প্রিন্টার্স, লেটার এন কালার এবং মোল্লা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স।
তারা গত কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করে কী পরিমাণ লেনদেন হয়েছে তা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনিয়ম এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুবিধা নিয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের অংশ হিসেবে আগের শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়েছে। সরকার ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ১২ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ কারণে নতুন শিক্ষাবর্ষে ছাপার জন্য মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ।
এছাড়া, গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক পাঠ্যবই ভারতে ছাপানো হলেও, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার পুরো মুদ্রণ কাজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। সবকিছু নতুন করে সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সরকার আওয়ামী আমলের পুরোনো দরপত্র বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করেছে।
নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের কারণে ইতোমধ্যে ৮০ হাজার পাঠ্যবই বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রায় ৩০ হাজার কপি প্রাথমিকের পাঠ্যবই এনসিটিবির মনিটরিং টিম হাতে-নাতে ধরে বাতিল করে। কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর ও উজ্জ্বলতা মান না থাকায় ফরাজী প্রেসকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আরও চারটি প্রেসের ৫০ হাজার বই বাতিল করা হয়।
সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, “সঠিক ইতিহাস যুক্ত করে সময়মতো পাঠ্যবই ছেপে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এবার পাঠ্যবইয়ে সঠিক ইতিহাস সংযোজনের কারণে কিছুটা দেরি হচ্ছে, যা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মেনে নিয়েছেন। তবে দেরি যেন আওয়ামী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে না হয়, সেটি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রতিবছর বই উৎসবের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক সফল শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন।
বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, “আওয়ামী লীগ আমলের অন্যান্য খাতের মাস্টারমাইন্ডদের যেভাবে গ্রেফতার করে অবৈধ টাকার উৎস উদঘাটন করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই পাঠ্যবই প্রকাশনা ও বিতরণ খাতে সিন্ডিকেটের হোতাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।”
কী ঘটেছে?
পাঠ্যবই মুদ্রণ ও সরবরাহে দেরির অজুহাতে মুদ্রণ শিল্প সমিতি শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে বিভ্রান্তিকর একটি আবেদন করে। এতে তারা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে তিনটি বই, ৫ মার্চের মধ্যে ৮০ শতাংশ বই এবং ২৫ মার্চের মধ্যে বাকি বই সরবরাহের প্রস্তাব দেয়।
আবেদন প্রত্যাহার কেন?
এই প্রস্তাব শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন মহলে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরে মুদ্রণ শিল্প সমিতি রাতেই আবেদনটি প্রত্যাহার করে এবং ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দেয় যে, সময়মতো সব বই সরবরাহ করা হবে।
কীভাবে প্রতিক্রিয়া এসেছে?
শিক্ষা উপদেষ্টা ও এনসিটিবির কর্মকর্তারা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে এই প্রস্তাব ক্ষোভ তৈরি করে।
মুচলেকার মাধ্যমে কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে?
সমিতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নির্দেশনা অনুযায়ী সময়মতো পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ করবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কার্যক্রমে যুক্ত হবে না।
ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ আশা করা হচ্ছে?
পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়া তদারকিতে কঠোর মনিটরিং চালানো হবে। অনিয়ম প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আরও স্বচ্ছভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
উপসংহার
পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির বিভ্রান্তিকর আবেদন ও পরবর্তীকালে তা প্রত্যাহারের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রক্রিয়াগুলোর অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টার কঠোর নজরদারি এবং সরকারের উদ্যোগে পাঠ্যবই বিতরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার্থীদের অধিকার ও ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কার্যক্রম প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।