বাংলাদেশে শিক্ষকদের নিজেদের দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায়ই এমন খবর পাওয়া যায়, যেখানে দুটি শিক্ষক বা শিক্ষক গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ, বিক্ষোভ এবং কখনো কখনো সংঘর্ষে অংশ নিতে দেখা যায়। সম্প্রতি, লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের মধ্যে এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার, তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে শিক্ষার্থীরা পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভে অংশ নেয়। উভয়পক্ষই পৃথক মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) অফিস ঘেরাও করে এবং বিরোধী পক্ষের শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়ক অবরোধ করে।

লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিটন চন্দ্র দেবনাথ এবং সহকারী শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াছমিন, নিজেদের পূর্ব শত্রুতার কারণে ছাত্রীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভে জড়িয়ে ফেলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের উস্কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে কিছুদিন ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং নানা ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যদিও উভয়েরই দাবি, তারা কোনো ছাত্রীকে বিক্ষোভে অংশ নিতে উত্সাহিত করেননি, বরং ছাত্রীরা নিজেদের ইচ্ছায় তাদের পক্ষে বিক্ষোভ করেছে।
বুধবার সকালে, লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্রীদের দুটি গ্রুপ পৃথকভাবে দুই শিক্ষকের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে তারা পরস্পরবিরোধী দুই শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে তারা লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলা এক ঘণ্টার অবরোধের কারণে সড়কে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ব্যাপক জনভোগান্তি সৃষ্টি হয়।
ফরিদা ইয়াছমিনের পক্ষে বিক্ষোভকারী ছাত্রীদের অভিযোগ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিটন চন্দ্র দেবনাথ বিভিন্নভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্যায়ভাবে নির্যাতন করে আসছেন। এ ছাড়া, বিদ্যালয়ের আয়া নিগার সুলতানা পূর্বে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও তুলেছিলেন।
অপরদিকে, লিটন চন্দ্র দেবনাথের পক্ষে বিক্ষোভকারী ছাত্রীদের অভিযোগ, সহকারী শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াছমিন তাদের কাছে প্রাইভেট না পড়ালে নানা অজুহাতে মারধর করেন। তারা আরও দাবি করেন যে, ফরিদা ইয়াছমিন সহকর্মী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে খারাপ আচরণ করে আসছেন।
জানা গেছে, ২১ নভেম্বর বিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষিকা শাহনাজ আক্তার ফরিদা ইয়াছমিনের অশালিন আচরণের বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অপরদিকে, শ্লীলতাহানির অভিযোগে লিটন চন্দ্র দেবনাথের বিরুদ্ধে ফরিদা ইয়াছমিন জেলা শিক্ষা অফিসার ও জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দেন।
এই অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সম্রাট খীসাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সম্রাট খীসা জানান, তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান এবং এর ফলস্বরূপ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে লিটন চন্দ্র দেবনাথ অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন এবং দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এসব অভিযোগ তার সম্মানহানি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যালয়ে উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল, যা মূলত প্রাইভেট পড়ানোকে কেন্দ্র করে দুই শিক্ষকের মধ্যে মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ। বিদ্যালয়ের একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক জানান, এই দ্বন্দ্বের কারণে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিশোদগার করছেন এবং ছাত্রীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিতে বাধ্য করছেন।
সম্প্রতি, বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে এসে অভিযুক্ত ওই দুই শিক্ষক একে অপরের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময়, তাদের অনুসারী শিক্ষিকারা ছাত্রীদের সঙ্গেও অশালীন আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই দ্বন্দ্বেরই প্রভাব পড়ে এবং এর ফলস্বরূপ ছাত্রীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন এবং বিক্ষোভে অংশ নেন।
এক পর্যায়ে, লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সম্রাট খীসা ঘটনাস্থলে এসে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সঙ্গে পৃথক আলোচনা করেন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। তার পরেই শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে সম্রাট খীসা জানান, জরুরি ভিত্তিতে এ ঘটনার তদন্ত করা হবে এবং এর ফলস্বরূপ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, দুই শিক্ষকের প্রতি কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হবে।
কেন ছাত্রীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ শুরু হলো?
ছাত্রীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ দুই শিক্ষকের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে শুরু হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিটন চন্দ্র দেবনাথ এবং সহকারী শিক্ষিকা ফরিদা ইয়াছমিনের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিক্ষোভে অংশ নেন।
বিক্ষোভের ফলে কোথায় সড়ক অবরোধ করা হয়?
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কে এক ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ করেন, যার ফলে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং চরম জনভোগান্তি সৃষ্টি হয়।
অবরোধের সময় কোন ধরনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল?
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা তাদের পক্ষে থাকা শিক্ষক বা শিক্ষিকার পদত্যাগের দাবিতে মিছিল এবং অবরোধ করেছিলেন। তারা নিজেদের পক্ষের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সম্রাট খীসা ঘটনাস্থলে এসে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং অবরোধ তুলে নেন। তিনি জানান, ঘটনার তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং শিক্ষক দুইজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে।
এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, সেজন্য কী পদক্ষেপ নেয়া হবে?
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সম্রাট খীসা জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
উপসংহার
এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কখনো কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। লক্ষ্মীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ঘটনা দেখিয়ে দিল যে, অভ্যন্তরীণ বিরোধে ছাত্রীদের জড়িয়ে পড়া একদিকে যেমন তাদের পড়াশোনায় বাধা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুনামও ক্ষুণ্ন হয়। জেলা প্রশাসন দ্রুত হস্তক্ষেপ করে বিষয়টির তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। তবে, এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও পেশাদারী সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং যেকোনো ধরনের মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্ব নিরসনে আরো সতর্কতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়।




