সরকারি কলেজে প্রদর্শক পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য মরিয়া নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ভেতরে অবৈধভাবে মিছিল এবং মানববন্ধন আয়োজন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ দর্শনার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
মঙ্গলবার শিক্ষা ভবনে কিছু সাধারণ নিয়োগ প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলের নামে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা আওয়ামী লীগ আমলে সাজানো নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তাদের সঙ্গে শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত আওয়ামী লীগপন্থী কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং আনসার সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে।

মজিবুর রহমান নামে একজন প্রার্থী বলেন, “আমি কোনো দল করি না। এখানে মিছিলে এসে কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, তাঁদের পরিচয় পেয়েছি। আমি শুনেছি, দীপু মনির পছন্দের এক কর্মকর্তাকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়েছেন একজন কর্মচারীর মাধ্যমে। সেই কর্মচারীই পরামর্শ দিয়েছেন, মিছিল ও লং মার্চ করলে সরকার ভয়ে দ্রুত ফল প্রকাশ করে দেবে। আর আনসার সদস্যরাও কৌশলে সহায়তা করবেন।”
এদিকে, দৈনিক শিক্ষাডটকমে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে ফোন করে নিয়োগপ্রার্থী পরিচয়ে বিরক্ত করা হতে থাকে। তাদের নাম-পরিচয় জানতে চাইলে, তারা পরিচয় না দিয়ে আপত্তিকর কথা বলতে থাকেন। এমনকি, বক্তব্য লিখে মেইলে পাঠানোর অনুরোধ করলেও তারা তাতে রাজি হননি। যেসব নাম্বার থেকে ফোন আসে, তাদের কয়েকটি নম্বর হলো: ০১৭৮৯৮০৩৭৬৬, ০১৮১৭৮০৪৭৫০, ০৯৬১১০৫৮৭৩৬, ০১৯৬২৪৮১২৭০, ০১৭১৪৩৩৩৯০৫। তারা সবাই জানান, নিউজের কারণে নিয়োগ বাতিল হলে তাদের ক্ষতি হবে। এছাড়া ০১৮৮৪৬১৪১৫১ নম্বর থেকে ফোন দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। এসব কলের রেকর্ড দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকমের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
গতকালের মিছিল প্রসঙ্গে শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের শখানেক নেতা-কর্মী প্রার্থী পরিচয়ে কোনো অনুমতি ছাড়াই মঙ্গলবার বেলা এগারোটার দিকে ঢুকে পড়েন অধিদপ্তরে। তাদের মিছিলে অফিসের কর্মপরিবেশ নষ্ট হয়। পুলিশ আসার খবর পেয়ে তারা দ্রুত সটকে পড়েন। আনসারদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, বুধবার থেকে এভাবে কেউ যেন অধিদপ্তরে ঢুকতে না পারে।
রংপুর থেকে নিজের কাজে শিক্ষা অধিদপ্তরে আসা হাইস্কুল শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, “দেখলাম কয়েকজন প্রদর্শক প্রার্থী আনসারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করছেন। এক পর্যায়ে তারা কয়েকজন নারী দর্শনার্থীর সঙ্গেও উচ্ছৃংখল আচরণ করেন। এরাই যদি সরকারি কলেজের প্রদর্শক হন, তাহলে জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার।”
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগপন্থী আনসার সদস্যদের সঙ্গে আঁতাত করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা অধিদপ্তরে ঢুকে পড়েছেন। তিনি আরও জানান, এসব আনসার সদস্যদের বরখাস্ত করা উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রদর্শক পদে নিয়োগের জন্য অনেকেই লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। যারা ঘুষ লেনদেনে জড়িত, তাদের অনেকেই এখনও শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত। আওয়ামী আমলের বিতর্কিত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার মতোই এসব নিয়োগ পরীক্ষাও বাতিলের দাবিতে অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন। ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতারা সম্মিলিতভাবে ফল প্রকাশের দাবি তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
যদিও হাজার হাজার প্রার্থী ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী দীপু মনির লোকদের সাজানো ওইসব লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষার দাবি তুলেছেন, তারা স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
উভয় ঘটনা নিয়েই দৈনিক আমাদের বার্তা এবং দৈনিক শিক্ষাডটকমে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রদর্শক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের অনুমতি চেয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি লেখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। ওই চিঠিটি ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জন প্রশাসনে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে অক্টোবরে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, “চার বছর আগে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই অনিয়ম নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখা দরকার। এছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তের নির্দেশ কেন বন্ধ হয়েছিলো, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।”
জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন সরকারি কলেজের জন্য দশটি বিষয়ে মোট ৬১০ জন প্রদর্শক ও সমমানের পদে নিয়োগের জন্য ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট নামকাওয়াস্তে ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়। নিয়োগ কমিটির কিছু সদস্য লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে থাকলেও সেটি আয়োজন করা হয়নি। টাকার বিনিময়ে এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে সরকারি কলেজগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে, এই প্রদর্শকরা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যুক্ত হয়ে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপকও হতে পারবেন।
এ সময়, শিক্ষা ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তারা কথিত ওই এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধীনে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, দশম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণির পদ হলেও, মাউশির নিয়োগবিধিতে এই পদগুলোকে তৃতীয় শ্রেণির হিসেবে দেখিয়ে শুধুমাত্র এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়।
আরো জানা যায়, দশম গ্রেডে ৫১৪ জন প্রদর্শক, একই গ্রেডে ২১ জন গবেষণা সহকারি, ৬৯ জন সহকারি গ্রন্থাগারিক-কাম-ক্যাটাগলার, এবং ৬ জন ল্যাব সহকারীসহ মোট ৬১০ জনের নিয়োগ দেওয়া হয়। পাঁচ সদস্যের নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার তৎকালীন পরিচালক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী, যিনি বিতর্কিত ছিলেন। কমিটির সদস্য হিসেবে আরও ছিলেন অধিদপ্তরের তৎকালীন সাধারণ প্রশাসন শাখার উপ-পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস (সদস্য-সচিব), এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা। ৫ আগস্টের পর সবাইকে অন্যত্র বদলি করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, “জেলে থাকা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং তার ভাই টিপু, চাঁদপুর পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারসহ নিয়োগ বাণিজ্যে অভিযুক্ত মাউশি অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বাছাইকৃত ছাত্রলীগ প্রার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে দেওয়াটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী। ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা ও নিয়োগ দেওয়া উচিত।”
সরকারি কলেজের কর্মচারী সমিতির নেতা হাবিবুর রহমান বলেন, “লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের শত শত নেতাকে সরকারি কলেজের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরির সুযোগ দিয়ে কলেজগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ বন্ধের জোর দাবি জানাই। নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানাই।”
কেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতারা নিয়োগ পেতে মরিয়া?
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতারা সরকারি কলেজে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে মরিয়া, কারণ তারা এই পদগুলোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে প্রবেশ করে পদোন্নতি পেতে চান, যার ফলে তারা অধ্যাপকও হতে পারবেন।
কী ধরনের অনিয়ম ঘটেছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়?
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমসিকিউ পরীক্ষা গ্রহণের সময় টাকার বিনিময়ে এবং রাজনৈতিক যোগসূত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
কী ধরনের পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে?
সরকারি কলেজের জন্য প্রদর্শক, গবেষণা সহকারী, সহকারি গ্রন্থাগারিক-কাম-ক্যাটাগলার এবং ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
কী ধরনের প্রতিবাদ উঠছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে?
প্রার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষাগুলো বাতিল করে নতুন পরীক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তারা বলেন, এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী।
কী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে?
সরকারি কলেজের কর্মচারী সমিতির নেতা হাবিবুর রহমান এবং অন্যরা নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা বন্ধ হওয়া উচিত।
উপসংহার
উপসংহারে, সরকারি কলেজের প্রদর্শক ও সমমানের পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবৈধভাবে নিয়োগে জড়িত থাকার অভিযোগ একটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংশোধনের দাবি উঠছে, বিশেষত ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। এই পরিস্থিতি শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে, যা সরকারের প্রতি সতর্কতার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রার্থীদের দাবি, এ ধরনের অসংগতি যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।




