রিভার্স ব্রেন ড্রেনই আমাদের শিক্ষার ক্রায়িং নিড: ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন

রিভার্স ব্রেন ড্রেনই আমাদের শিক্ষার ক্রায়িং নিড: ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন

‘তত্ত্বের গণ্ডি পেরিয়ে তরুণ প্রজন্মকে চাকরির বাজার, শিল্প ও সমাজের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শিক্ষার সঙ্গে চাহিদার সঠিক সমন্বয় অপরিহার্য। চাহিদানির্ভর শিক্ষা কেবল একটি পাঠ্যক্রম নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি।’

আশা ছিল, আমাদের নোবেল বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা একটি ট্যালেন্ট পুল তৈরি করবেন। সেই পুল থেকে নির্বাচিত মেধাবীদের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হবে, যেখানে তারা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করবেন। শিক্ষাজীবন শেষে তারা নিজ দেশে ফিরে এসে জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যয়ের দায়িত্ব নেওয়া হবে এবং দেশে ফেরার পর সম্মানজনক পদে নিয়োগের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতা কাজে লাগানো হবে। এভাবেই ঘটবে রিভার্স ব্রেন ড্রেন—যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বা এক কথায় crying need। মেধা পাচার রোধে ‘ট্যালেন্ট হান্ট পুল’ সময়ের দাবিই নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের অপরিহার্য ভিত্তি।

বাংলাদেশে চাহিদামুখী শিক্ষার এই তীব্র প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যাশার বাস্তবচিত্র তুলে ধরেন সাবেক সফল শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন। তার নেতৃত্বাধীন শিক্ষা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই) শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) অডিটোরিয়ামে বিশেষ এক সেমিনারের আয়োজন করে।

‘Need Based Education in Bangladesh: Problems and Prospects’ শীর্ষক এ সেমিনার সকালে শুরু হয়ে দুপুর পর্যন্ত চলে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সাঈদ ফেরদৌস।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারের সঞ্চালনা করেন ইআরআই-এর সদস্যসচিব সৈয়দ রেজওয়ানুল কবীর।

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন তার বক্তব্যে বলেন, তরুণ প্রজন্মকে শুধুমাত্র তত্ত্বভিত্তিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না; তাদেরকে চাকরির বাজার, শিল্প এবং সমাজের বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে মানিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য শিক্ষার সঙ্গে চাহিদার সঠিক সমন্বয় অপরিহার্য। তার মতে, চাহিদামুখী শিক্ষা কোনো পাঠ্যক্রমমাত্র নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি—যা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক দক্ষতা বাড়ায়, সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করে। তিনি আরও বলেন, গ্যারি বেকারের হিউম্যান ক্যাপিটাল থিওরি ও ডেভিড রিকার্ডোর তুলনামূলক অ্যাডভান্টেজ তত্ত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা একইসঙ্গে জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বিনিয়োগ এবং প্রতিযোগিতামূলক হাতিয়ার।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, দেশে ৩৬ হাজার পোস্ট-প্রাইমারি প্রতিষ্ঠান, প্রায় ২ কোটি শিক্ষার্থী এবং সাড়ে ৬ লাখ শিক্ষক থাকলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক—৩২.৮৫% ও ২১.৫১%। তিনি সতর্ক করে বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে জেনারেশন জি ও জেনারেশন আলফা বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা হয়ে উঠবে। যদি তাদের চাহিদানির্ভর দক্ষতা নিশ্চিত করা না যায়, তবে সম্ভাবনাময় জনশক্তিই একসময় জাতীয় বোঝায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।

ড. মিলন আরও বলেন, শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম কার্যকর পথ হলো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (TVET)। এটি আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক—যেকোনো কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে একীভূত করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় কিংবা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ও গড়ে তোলা যেতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চাহিদামুখী শিক্ষা কেবল কর্মী তৈরি করবে না; এটি দক্ষ সমস্যা সমাধানকারী, উদ্ভাবক ও নেতা তৈরির ক্ষেত্রও তৈরি করবে। এর পাঠ্যক্রম হবে প্রকৃত শ্রমবাজারের প্রয়োজনের ভিত্তিতে। তবে এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার বাস্তব সমন্বয়, যথাযথ তহবিল এবং সর্বোপরি মানসিকতার পরিবর্তন। তাহলেই শিক্ষা গ্রেডের দৌড় থেকে বের হয়ে অর্থবহ কর্মসংস্থান ও জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

তিনি মনে করিয়ে দেন: সুনির্দিষ্ট দক্ষতা ছাড়া শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হলো কম্পাসহীন জাহাজের মতো। চাহিদামুখী শিক্ষা বাস্তবায়নই আমাদেরকে একটি সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও টেকসই বাংলাদেশ গঠনের পথে এগিয়ে নেবে।

ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন বলেছেন, উদ্ভাবনী দক্ষতা অর্জন এখন সময়ের দাবি। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে বিপুল জনসংখ্যাকে উৎপাদনশীল ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার বিকল্প নেই। চাহিদামুখী শিক্ষা প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শিল্প প্রস্তুত কর্মী তৈরি করে এবং সামষ্টিক পর্যায়ে শিল্প শক্তিকে মজবুত করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। একইসঙ্গে এটি শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সমন্বিত করে আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের পথ সুগম করে।

তবে তিনি স্বীকার করেন, এ লক্ষ্য অর্জনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনেক স্নাতকের মধ্যেই প্রয়োজনীয় ডিজিটাল, কারিগরি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ তরুণ উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ পান না। অথচ বিশ্বব্যাপী দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা গেলে বাংলাদেশও একটি প্রতিযোগিতামূলক, জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মালয়েশিয়ার সাফল্য মডেল হিসেবে অনুসরণযোগ্য। এর জন্য দরকার হবে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পনীতি, শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও যথাযথ বিনিয়োগ।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করতে হবে, ইন্টার্নশিপ হতে হবে পেশাভিত্তিক, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে সুযোগ হতে হবে উন্মুক্ত ও সহজলভ্য। বাংলাদেশের শক্তি হলো তরুণ কর্মশক্তি এবং তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতের অভিযোজন ক্ষমতা। কিন্তু ঝরে পড়ার হার ও দক্ষতার ঘাটতি বড় দুর্বলতা। তাই প্রতিটি তরুণকে বাজারযোগ্য দক্ষতায় সজ্জিত করা, প্রতিটি স্নাতককে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করা এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় ও বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা জরুরি।

ড. মিলন সতর্ক করেন, যদি এখনই চাহিদানির্ভর শিক্ষা সর্বস্তরে বাস্তবায়ন না করা হয়, তবে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পিছিয়ে পড়বে। সবুজ জ্বালানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা ও উন্নত উৎপাদন খাতে বৈশ্বিক চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। দেরি মানে হবে দক্ষতা রপ্তানির পরিবর্তে দক্ষতা আমদানির ঝুঁকি। তাই শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, প্রতিটি পাঠ্যক্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে শিল্প সহযোগিতা যুক্ত করতে হবে এবং সব শিক্ষা অবকাঠামোকে ডিজিটাল ও জলবায়ু সহনশীলতায় সক্ষম করতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই)-এর সদস্য সচিব সৈয়দ রেজাওয়ানুল কবীর বলেন, উত্তম রাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রফেশনাল ও সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চাহিদানির্ভর শিক্ষাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সাঈদ ফেরদৌস বলেন, শুধুমাত্র এমএ বা এসএসসি সার্টিফিকেট নয়, কর্মমুখী শিক্ষার দিকে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

রিভার্স ব্রেন ড্রেন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?

রিভার্স ব্রেন ড্রেন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে দেশের মেধাবীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা দক্ষতা অর্জনের পর আবার নিজ দেশে ফিরে এসে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখেন।

কেন ড. মিলন এটিকে বাংলাদেশের শিক্ষার জন্য “ক্রায়িং নিড” বলেছেন?

বাংলাদেশে বিপুল তরুণ জনসংখ্যা রয়েছে। তাদেরকে যদি দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত না করা যায়, তাহলে সম্ভাবনা বোঝায় পরিণত হবে। রিভার্স ব্রেন ড্রেনের মাধ্যমে মেধাকে দেশের ভেতরে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে কী ধরনের পদক্ষেপ দরকার?

উত্তর: সরকারের উদ্যোগে একটি ট্যালেন্ট হান্ট পুল গঠন করতে হবে। সেই পুল থেকে নির্বাচিত তরুণদের বিদেশে পাঠিয়ে উপযোগী শিক্ষা প্রদান করতে হবে এবং তাদের খরচ বহন করতে হবে রাষ্ট্রকে। পরে সম্মানজনক সুযোগ তৈরি করে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।

রিভার্স ব্রেন ড্রেন বাস্তবায়ন হলে কী সুফল পাওয়া যাবে?

  • মেধা পাচার রোধ হবে
  • দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে
  • শিক্ষা ও শিল্পের মধ্যে সমন্বয় ঘটবে
  • জাতীয় উন্নয়নে উদ্ভাবনী নেতৃত্ব তৈরি হবে

এর পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী কী?

উত্তর: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি শিল্পনীতি, পর্যাপ্ত তহবিল ও মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া এটি বাস্তবায়ন কঠিন। পাশাপাশি পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোকে আধুনিকীকরণ করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের জন্য চাহিদানির্ভর শিক্ষা ও রিভার্স ব্রেন ড্রেন সময়ের অপরিহার্য দাবি। তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা না গেলে সম্ভাবনা বোঝায় পরিণত হবে। তাই পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ, শিল্প-শিক্ষার সমন্বয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দক্ষতা, উদ্ভাবন ও অভিযোজনক্ষমতা দিয়েই বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top