বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষে গড়ে ৭৬ দিন ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে। প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় এই ছুটির সংখ্যা ১৬ থেকে ২০ দিন কমিয়ে ৫৬ থেকে ৬০ দিনে নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ছুটি যুক্ত হচ্ছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটির সংখ্যা হ্রাসের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের দৈনিক কর্মঘণ্টাও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। এসব সিদ্ধান্ত আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে গড়ে বছরে ৭৬ দিন ছুটি দেওয়া হয়। নতুন প্রস্তাবনায় এই ছুটি ১৬ থেকে ২০ দিন কমিয়ে ৫৬ থেকে ৬০ দিনে নির্ধারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে আপাতত শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটিতে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি এই দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথসভায় বার্ষিক ছুটি কমানোর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) বেগম বদরুন নাহার ডলি। এতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।
চলতি বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ছুটির সংখ্যা কমানো হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মতামত যাচাই-বাছাই করে ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষাপঞ্জি তৈরির সময় থেকে এই পরিবর্তন কার্যকর করার চিন্তা করছে সরকার। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে স্কুল পর্যায়ে বার্ষিক ছুটি নির্ধারিত রয়েছে ৭৬ দিন, আর কলেজ পর্যায়ে তা ৭১ দিন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই ছুটি হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা থাকলেও, ২০২৬ সাল থেকে তা কার্যকর হওয়াই বেশি সম্ভাব্য।
বর্তমানে বিদ্যালয়গুলোতে ৭৬ দিনের বার্ষিক ছুটির পাশাপাশি সাপ্তাহিক ছুটি থাকে ৫২ থেকে ৫৩ দিন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রশাসনিক কারণে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ছুটি বেড়ে যায়। এর ফলে পাঠদানে ঘাটতি দেখা দেয় এবং শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই অগ্রসর হয়।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার শুধু ছুটি কমানো নয়, বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির বিষয়েও ভাবনা-চিন্তা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠদানের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে কর্মঘণ্টা বাড়ানো জরুরি। এ বিষয়ে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গঠিত প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন পরামর্শক কমিটি ইতোমধ্যেই একাধিক সুপারিশ জমা দিয়েছে। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ।
ছুটি ও কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা আনা এবং শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি কমানোই সরকারের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।
দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটি কমিয়ে কর্মঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগকে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন পরামর্শক কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় দুই শিফটে পরিচালিত হয়। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শেখার সময় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম। তাই শেখার ঘাটতি পূরণে কর্মঘণ্টা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি বলে মত দিয়েছেন তারা।
তবে এই পরিকল্পনার বিপরীতে ভিন্ন মত রয়েছে কিছু অংশে। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলো বরং বিদ্যালয়ের সময়সূচি কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদ বিদ্যালয়ের সময় নির্ধারণ করে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাখার দাবি তোলে।
এ বিষয়ে পরামর্শক কমিটির প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, “শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণে ছুটি কমানো এবং কর্মঘণ্টা বাড়ানো সময়ের দাবি। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের সুপারিশে এসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়েছে; এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের।”
এদিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান সংবাদমাধ্যমকে জানান, “ছুটি কমানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আরও সভা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।”

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
কখন থেকে ছুটি কমানো এবং কর্মঘণ্টা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে?
সরকার ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে বার্ষিক ছুটি কমানো এবং বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। চলতি বছর বা ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এই পরিবর্তন কার্যকর হবে না।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত দিনের ছুটি দেওয়া হয়?
বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে গড়ে বছরে ৭৬ দিন বার্ষিক ছুটি এবং ৫২-৫৩ দিন সাপ্তাহিক ছুটি রয়েছে।
ছুটি কমানোর পেছনে মূল কারণ কী?
আন্দোলন, দুর্যোগ এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে অতিরিক্ত ছুটি যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি বাড়ছে। এই ঘাটতি পূরণ করতেই ছুটি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
কর্মঘণ্টা কীভাবে বাড়ানো হবে?
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৈনিক ক্লাস সময়সীমা দীর্ঘ করা হবে। তবে চূড়ান্ত সময়সূচি নির্ধারণে এখনো আলোচনা চলছে।
শিক্ষক সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে অবস্থান কী?
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলো সময়সূচি আরও সংক্ষিপ্ত করার দাবি জানিয়েছে। তারা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে।
উপসংহার
শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ এবং শিক্ষা কার্যক্রমে গুণগত উন্নয়ন আনতে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটি কমিয়ে কর্মঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যদিও এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কিছু মতবিরোধ রয়েছে, তবুও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি ও আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এই পরিকল্পনা শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।




