গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার উদ্যোগকে “বিকৃত মনোযোগের বিভ্রান্তি” বলে উল্লেখ করেছেন সাহায্য সংস্থাগুলোর নেতারা। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ গাজায় ক্রমবর্ধমান দুর্ভিক্ষের সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনো সমাধান নয়।

রবিবার সকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা গাজা উপত্যকায় মানবিক ত্রাণ ফেলা শুরু করেছে। এর আগে জাতিসংঘের ত্রাণবাহী কনভয়ের জন্য মানবিক করিডোর চালুর কথাও জানায় তারা।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও জর্ডানও আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ ধরনের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানান, তার সরকারও গাজায় বিমান ত্রাণ পৌঁছাতে “যা কিছু সম্ভব” সবকিছু করছে।
তবে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (IRC) সিয়ারান ডনেলি বলেন, “বিমান থেকে ত্রাণ ফেলে কখনোই প্রয়োজনীয় পরিমাণ বা মানসম্পন্ন সহায়তা দেওয়া সম্ভব নয়।”
এরই মধ্যে ১০০-র বেশি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন গাজায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার অপুষ্টিজনিত কারণে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মোট মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৭-এ, যার মধ্যে ৮৫ জনই শিশু।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) সতর্ক করেছে যে, গাজায় প্রতি তিনজনের একজন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকছেন। প্রায় ৯০ হাজার নারী ও শিশুর জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন, যা সংস্থাটি “মানবসৃষ্ট ব্যাপক দুর্ভিক্ষ” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার উদ্যোগ মূলত এসেছে পারম্পরিক স্থলপথে ত্রাণ প্রবেশে বারবার ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংস্থা UNRWA-র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি শনিবার বলেন, বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা “ব্যয়বহুল, অকার্যকর এবং ভুল হলে না খেয়ে থাকা মানুষদের প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।”
তিনি জানান, জর্ডান ও মিশরে সংস্থার হাতে থাকা ত্রাণসামগ্রী ৬,০০০ ট্রাকের সমপরিমাণ, যা গাজায় প্রবেশের জন্য অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।
লাজারিনি বলেন, “অবরোধ প্রত্যাহার, প্রবেশপথ খুলে দেওয়া এবং নিরাপদ, সম্মানজনক সহায়তা পৌঁছাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “স্থলপথে সহায়তা পাঠানো অনেক সহজ, দ্রুত, কার্যকর, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ — এবং গাজার মানুষের জন্যও সম্মানজনক।”
তার এই বক্তব্যের আগেই ইসরায়েল “নির্দিষ্ট মানবিক করিডোর” চালুর ঘোষণা দেয়, যাতে জাতিসংঘের খাদ্য ও ওষুধবাহী কনভয় নিরাপদে চলাচল করতে পারে। তবে করিডোরগুলো কোথায় এবং কীভাবে কাজ করবে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা গাজায় সহায়তা প্রবেশে কোনো বাধা দেয়নি। বরং এক সরকারি মুখপাত্র অভিযোগ করেন, জাতিসংঘ হামাসের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে ত্রাণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত করছে।

জাতিসংঘ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে, ইসরায়েলি بيرোক্রেটিক জটিলতার কারণে গাজায় কার্যকরভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
হামাসও দাবি করেছে, তারা কোনো ত্রাণ চুরি করেনি। সম্প্রতি ইউএসএইড-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহায়তা চুরির কোনও পদ্ধতিগত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই প্রথম নয়, পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো এর আগেও গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত বছর ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্স জর্ডান-নেতৃত্বাধীন এক আন্তর্জাতিক উদ্যোগে অংশ নিয়ে ১০টি মিশনে ১১০ টন ত্রাণ ফেলে।
তবে সাহায্য সংস্থাগুলোর মতে, এত অল্প পরিমাণ ত্রাণ গাজায় চলমান দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় একেবারেই অপ্রতুল।
BBC-র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজার প্রায় ২১ লাখ মানুষের জন্য একবেলা খাবার পৌঁছাতে প্রয়োজন হবে অন্তত ১৬০টি বিমানের ফ্লাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টকম (Centcom) জানিয়েছে, তাদের C-130 কার্গো বিমান প্রতি ফ্লাইটে গড়ে প্রায় ১২,৬৫০টি খাবার সরবরাহ করতে পারে। এই হিসেবে, গাজায় একবারে একবেলার খাবার পৌঁছাতে ১৬০টির বেশি ফ্লাইট লাগবে।
জানা গেছে, জর্ডানের কাছে রয়েছে প্রায় ১০টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের রয়েছে আরও ৮টি C-130 বিমান।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
সাহায্য সংস্থাগুলো গাজায় বিমান ত্রাণ সম্পর্কে কী বলেছে?
তারা একে “অদ্ভুত বিভ্রান্তি” হিসেবে অভিহিত করেছে এবং বলেছে, এটি গাজায় ক্রমবর্ধমান দুর্ভিক্ষের প্রকৃত সমাধান নয়।
গাজায় বিমান ত্রাণ ফেলার কী ধরনের ঝুঁকি রয়েছে?
আকাশ থেকে বাক্স পড়ার কারণে মানুষ আহত হচ্ছে, অনেকে সমুদ্রে পড়ে যাচ্ছেন, এবং ত্রাণ বিতরণস্থলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থলপথে ত্রাণ প্রবেশে বাধা কোথায়?
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি بيرোক্রেটিক জটিলতা ও রাজনৈতিক বাধার কারণে গাজায় যথাযথভাবে ত্রাণ প্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না।
বিমান ত্রাণ কি গাজাবাসীর চাহিদা পূরণে যথেষ্ট?
না, বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজায় একবেলার খাবার পৌঁছাতে ১৬০টির বেশি বিমান ফ্লাইট প্রয়োজন, যা বাস্তবসম্মত নয়।
গাজায় মানবিক পরিস্থিতি বর্তমানে কেমন?
বেশিরভাগ মানুষ বারবার বাস্তুচ্যুত, খাবার ও পানির মারাত্মক সংকট রয়েছে, এবং ৯০% বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত।
উপসংহার
গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা বর্তমান মানবিক সংকটে খুব সীমিত সহায়তা দিতে পারলেও এটি মূল সমস্যার সমাধান নয়। সাহায্য সংস্থাগুলো একে বিভ্রান্তিকর এবং বিপজ্জনক বলে অভিহিত করেছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার সংকটে জর্জরিত গাজাবাসীর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো নিরাপদ ও স্থলপথে পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই পারে এই সংকটের টেকসই সমাধান দিতে।




