“পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, এবার শিক্ষা খাত অগ্রাধিকার পাবে এবং এর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে।”

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে, যা প্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোকে অনেকের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, নতুন বাস্তবতায় শিক্ষা খাত অগ্রাধিকার পাবে এবং এর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে।
অন্যদিকে, আসন্ন অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত করতে আজ রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
খাতভিত্তিক প্রস্তাবিত বরাদ্দে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত—যা আগের বছরগুলোতেও উচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। এবার শিক্ষা খাত তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে গৃহায়ণ এবং স্বাস্থ্য খাত।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি যেন না হয় এবং প্রকল্পগুলো যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়—সে কারণেই খাতভিত্তিক বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।”
তিনি জানান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নতুন অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বরং এই দুই গুরুত্বপূর্ণ খাতে গুণগত ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
উন্নয়ন বাজেটকে তথাকথিত ‘দুষ্টু চক্র’ থেকে বের করে আনতে নেওয়া হচ্ছে কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ। উপদেষ্টা বলেন, “এবার চলমান প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নতুন বা মেগা প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকছি। ব্যয়সংযমের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অসংগতি রোধে পরিবীক্ষণ জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের (এডিপি) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নের হার আশানুরূপ না হওয়ায় তা সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বাস্তবায়নে ধীরগতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এই অর্থবছরেও।
এর আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালে সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ কোটি টাকা। অথচ বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৮১ শতাংশ, যা কাঙ্ক্ষিত থেকে অনেকটাই কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত সরকারগুলোর সময় বড় আকারের এডিপি ঘোষণা করা হলেও বাস্তবায়নে ছিল ঘাটতি। তাই এবার বরাদ্দ কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সম্ভাব্য এডিপিতে শিক্ষা খাতের জন্য ৯১টি প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের তুলনায় ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। শতকরা হারে এই কমতির হার প্রায় ৯.5 শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। আগামী অর্থবছরে ৩৫টি প্রকল্পে এই খাতে বরাদ্দ থাকছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১২.২৯ শতাংশ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর বড় অংশজুড়ে রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ—যেমন স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালের ভবন। কিন্তু এসব প্রকল্পে গুণগত মান উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সীমিত থাকে। ফলে কাঙ্ক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানোর প্রেক্ষাপটে হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ বিনিয়োগ না হলে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে।
তারা বলেন, “শিক্ষায় ব্যয় নয়, এটি একটি কার্যকর বিনিয়োগ। কিন্তু আমরা সেই বিনিয়োগ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছি না।”
বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায়ও কম। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর তারা জোর দেন, যেখানে বরাদ্দ কমে যাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে।
নতুন এডিপির খসড়া ও প্রকল্প কাঠামো
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া এডিপি অনুসারে, আগামী অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট ১,১৭০টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর মধ্যে রয়েছে:
৯৯২টি বিনিয়োগ প্রকল্প
১৯টি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প
৯৯টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প
৬০টি সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প
পিপিপি ও জলবায়ু তহবিলের আওতায় বিশেষ উদ্যোগ
৭৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে।
২২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায়, যা পরিবেশগত ও জলবায়ুগত টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
সমাপ্তির লক্ষ্যে ২৫৪টি প্রকল্প চূড়ান্ত পর্যায়ে
প্রস্তাবিত এডিপিতে ২৫৪টি প্রকল্পকে ‘আবশ্যিকভাবে সমাপ্ত করার লক্ষ্যে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
২০৮টি বিনিয়োগ প্রকল্প
১১টি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প
১৬টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প
১৯টি সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ কমছে কেন?
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি রোধ, বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বাজেট বাস্তবায়নের হার কম হওয়ায় এ বছর খাতভিত্তিক বরাদ্দ কমানো হয়েছে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে গুণগত উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
আগের বছরের তুলনায় কত শতাংশ বরাদ্দ কমেছে?
চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৯.৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম।
কোন ধরণের প্রকল্পগুলো বেশি কাটা পড়ছে?
বেশিরভাগ অবকাঠামোভিত্তিক প্রকল্প—যেমন স্কুল, কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ তেমনভাবে বাড়েনি।
বাজেট কমানোর এই সিদ্ধান্তে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
মানবসম্পদ উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ কম হলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতে পারে।
তাহলে কি নতুন কোনো শিক্ষাখাত প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না?
নতুন বড় প্রকল্প নেওয়া নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করাই মূল লক্ষ্য। তবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
উপসংহার
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমে যাওয়া শুধু একটি সংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরে। বাজেট বাস্তবায়নের বাস্তবতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যয়সংযমের যুক্তিতে খাতভিত্তিক বরাদ্দে কাটছাঁট করা হলেও, শিক্ষা খাতের মতো মৌলিক খাতে এমন সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বারবার উল্লেখ করেছেন—শিক্ষায় ব্যয় নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে শুধু দক্ষ জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে ওঠে। সুতরাং বাজেট বরাদ্দের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিমাণের চেয়ে প্রাধান্য পাওয়া উচিত শিক্ষার গুণগত মান ও প্রাসঙ্গিকতা।
অতএব, বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হলেও, তা যেন ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত না করে—এ বিষয়ে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকতে হবে।




