“অনেকে কোরবানির পশু কেনার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও, তা আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেন না।”

অনেক করদাতা কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চায়, করদাতারা এসব ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে আয়কর বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করুন। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আয়কর ফাঁকি প্রতিরোধ এবং কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী বছর থেকে লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের কোরবানির পশু ক্রয়ের তথ্য আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হবে। এ ছাড়া রিটার্ন ফরমের প্রতিটি ঘর সঠিকভাবে পূরণ না করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং ফরম জমা দেওয়া যাবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্র অনুযায়ী, করশৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছর থেকে আয়কর রিটার্ন জমার পদ্ধতিতে আসছে বড় পরিবর্তন। করদাতারা আর ম্যানুয়ালি (হাতে লিখে বা কাগজে) রিটার্ন জমা দিতে পারবেন না; রিটার্ন জমা দিতে হবে সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতিতে। করযোগ্য আয় না থাকলেও যাদের ই-টিআইএন রয়েছে, তাদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, এই নির্দেশনা অমান্য করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে জেল ও জরিমানা, আয়কর হিসাব জব্দ, এমনকি প্রয়োজনে মামলা করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “ই-টিআইএন থাকলেও গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত রিটার্ন জমা দেন না। বছরের পর বছর এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। তাই আগামী অর্থবছর থেকে এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, রিটার্ন ফরমে খুব কম তথ্য চাওয়া হলেও ম্যানুয়াল রিটার্নে করদাতারা অনেক সময় প্রয়োজনীয় তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ করেন না। বিশেষ করে মোট আয় ও মোট ব্যয়ের তথ্য উল্লেখ না করার প্রবণতা দেখা যায়, যা অনিয়মের শামিল।
নতুন অনলাইন রিটার্ন সাবমিশন সিস্টেম এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে, যেখানে রিটার্ন ফরমের প্রতিটি ঘর পূরণ না করলে তা সাবমিট করা যাবে না—ফলে রিটার্নও গৃহীত হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আয়কর বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে সরকারি চাকরিজীবীরা বোনাস পান, আর ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যয়ও হয়ে থাকে উল্লেখযোগ্য। আয়কর রিটার্নে উৎসব ব্যয়ের জন্য একটি নির্ধারিত ঘর রয়েছে, যেখানে করদাতাদের ভবিষ্যতে কোরবানির পশু কেনায় ব্যয়ের পরিমাণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত রাজস্ব বাজেট সংক্রান্ত একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অনেক করদাতা কোরবানির পশু কেনার জন্য লক্ষাধিক এমনকি আট, দশ কিংবা পঞ্চাশ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকেন। কিন্তু এসব ব্যয়ের হিসাব তারা আয়কর রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করেন না। ফলে কর প্রশাসনের কাছে প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের ব্যবচ্ছেদ অসম্পূর্ণ থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর থেকে কোরবানির পশু কেনায় বড় অঙ্কের ব্যয়ের তথ্য রিটার্নে উল্লেখ না করলে তা ‘তথ্য গোপন’ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা কর আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
গত ২২ অক্টোবর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল ফোন অপারেটর এবং একাধিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। পাশাপাশি, অন্যান্য করদাতাদেরও অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে অনলাইনে প্রায় ১৭ লাখ আয়কর রিটার্ন দাখিল হয়েছে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা না দিলে করদাতারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেবা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
যেমন:
কর অব্যাহতির সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। ফলে যেকোনো অব্যাহত আয়ের উৎস করযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
- করমুক্ত আয়ের সীমা প্রযোজ্য হবে না।
- হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা বাতিল হবে।
- বিনিয়োগের বিপরীতে কর রেয়াত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
- অতিরিক্ত কর পরিশোধ করতে হবে এবং
- জরিমানা গুণতে হবে নির্ধারিত হারে।
- এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কর প্রশাসন চায় সময়মতো রিটার্ন দাখিলের সংস্কৃতি গড়ে উঠুক এবং কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক।
এতদিন আয়কর শনাক্তকরণ নম্বর (ই-টিআইএন) না থাকলে ৪০টির বেশি সরকারি-বেসরকারি সেবা ও সুবিধা গ্রহণ সম্ভব ছিল না। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে শুধু ই-টিআইএন থাকলেই হবে না; সময়মতো আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে বহু গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকেও বঞ্চিত হতে হবে।
রিটার্ন দাখিল না করলে যেসব সেবা মিলবে না, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সেবা:
- ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন (সিটি করপোরেশন/পৌরসভা)
- আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম
- বাণিজ্যিক ও শিল্প গ্যাস সংযোগ গ্রহণ ও নবায়ন
- পরিবেশ অধিদপ্তর/জেলা প্রশাসন থেকে ইটভাটার অনুমতি ও নবায়ন
- আর্থিক সেবা:
- ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ গ্রহণ (যদিও করযোগ্য আয় না থাকলেও)
- ভিসা আবেদনে আয়কর জমার প্রমাণপত্র
- পেশাগত অনুমোদন ও লাইসেন্স:
- চিকিৎসক, দন্তচিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার, চার্টার্ড ও কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টদের জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ ও নবায়ন
- সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার হিসেবে নিবন্ধন
- শিক্ষা সংক্রান্ত:
- ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি
- এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে করব্যবস্থার আওতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা, এবং রিটার্ন দাখিলকে শুধুমাত্র কর দেওয়ার বিষয় না ভেবে নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
কোরবানির খরচ আয়কর রিটার্নে কেন দেখাতে হবে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মনে করে, করদাতার ব্যয়ের ধরন তার প্রকৃত আয় সম্পর্কে ধারণা দেয়। অনেক করদাতা লক্ষাধিক টাকায় কোরবানির পশু কিনলেও তা রিটার্নে উল্লেখ করেন না, ফলে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা বিঘ্নিত হয়। তাই ব্যয়ের অংশ হিসেবে কোরবানির খরচও রিটার্নে দেখানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
কত টাকা হলে কোরবানির খরচ রিটার্নে দেখাতে হবে?
নির্দিষ্ট অঙ্ক এখনো সরকারিভাবে ঘোষণা না হলেও প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী লাখ টাকার ওপরে পশু কেনার তথ্য অবশ্যই রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। আরও বিস্তারিত নির্দেশনা আসন্ন বাজেট বক্তৃতায় দেওয়া হবে।
কোন ঘরে কোরবানির খরচ দেখাতে হবে?
আয়কর রিটার্ন ফরমে “উৎসব ব্যয়” নামে একটি নির্ধারিত ঘর রয়েছে। ওই ঘরেই কোরবানির পশু কেনায় ব্যয়িত অর্থ দেখাতে হবে। ভবিষ্যতে সফটওয়্যার এমনভাবে তৈরি থাকবে, যাতে তথ্য না দিলে রিটার্ন জমা সম্ভব না হয়।
এই খরচ কি করযোগ্য আয় বাড়াবে বা কর দিতে হবে?
না, কোরবানির খরচ সরাসরি করযোগ্য আয় বাড়াবে না। তবে এটি করদাতার ব্যয়ক্ষমতা নির্দেশ করবে। ব্যয় অনেক বেশি হলে কিন্তু আয় কম দেখানো হলে এনবিআর সেটিকে যাচাই করতে পারে।
রিটার্নে কোরবানির খরচ না দেখালে কী হবে?
কোরবানির পশু কেনার মতো বড় ব্যয় রিটার্নে না দেখালে তা “তথ্য গোপন” হিসেবে গণ্য হতে পারে। কর আইনের আওতায় এ ধরনের গোপন তথ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে—ফলে জরিমানা, তদন্ত, এমনকি মামলা হতে পারে।
উপসংহার
করের আওতা বাড়ানো, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং কর ফাঁকি রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে, তার মধ্যে কোরবানির পশু ক্রয়ের ব্যয় রিটার্নে প্রদর্শনের বিষয়টি একটি বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে করের আওতায় আনার প্রচেষ্টা নয়, বরং করদাতার জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ক্ষমতার সঙ্গে তার ঘোষিত আয়ের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস। রিটার্ন দাখিল এখন শুধু একটি ফর্মালিটি নয়, বরং নাগরিক দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার প্রতীক হয়ে উঠছে। এই সংস্কৃতির বিকাশে সবার সহযোগিতা জরুরি।




