২৬ মার্চ প্রসঙ্গে পাঠ্যপুস্তক কী বলছে

২৬ মার্চ প্রসঙ্গে পাঠ্যপুস্তক কী বলছে

বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে সংশোধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কিত বিষয়গুলো বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা দেখতে হলে আমরা তিনটি ভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের হাইলাইটস সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। এখানে ৬ষ্ঠ, ৮ম এবং ১০ম শ্রেণির কিছু নির্বাচিত বইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হবে, যাতে বোঝা যায়, জাতির ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব কীভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলা চালিয়ে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ করলে, পুলিশ লাইনস বেইজ থেকে আক্রমণের খবর তার বার্তার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। একই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা হয়। পরদিন, ২৬ মার্চ, মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয় এবং পাকিস্তানি শাসন, যার বয়স ছিল ২৪ বছর, চিরতরে অবসান ঘটে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পৃষ্ঠা: ১৪

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে, বাঙালির এবং বিশ্ব ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা ‘কালরাত্রি’ নামে পরিচিত। ওই রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র, নিরীহ, স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। পাকিস্তান তাদের এই বর্বর অভিযানটির নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

১৮ই মার্চ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডার টিক্কা খান এবং রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা বাঙালির উপর এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা তৈরি করেন। ১৯শে মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়। ২০শে মার্চ, পাকিস্তান সরকার অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। একই দিনে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পিরজাদা এবং জেনারেল ওমরসহ অন্যান্য সামরিক নেতাদের নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। সেই সময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত পিআইএ ফ্লাইট বোয়িং ৭০৭ বিমান সৈন্য ও রসদ নিয়ে ঢাকা আসে এবং অসংখ্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে থাকে।

২৪শে মার্চ, চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র এবং রসদ খালাস শুরু হয়। সব প্রস্তুতি শেষে, ২৫শে মার্চ বাঙালির উপর নৃশংস গণহত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দিনটি নির্ধারণ করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ দিনটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো দিন, যেদিন নিরীহ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যার ফলে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় সংগ্রাম।

সেদিন, ২৫শে মার্চ রাতের গভীরতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন হলগুলোতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ এবং পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। একইভাবে পিলখানা, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এসব জায়গায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়। পুরনো ঢাকা, কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিমানবন্দর, রায়েরবাজার, গণকটুলি, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য শহরেও পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে।

এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে, ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরদিন ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন। মেজর জিয়ার এই স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এর প্রতি বাঙালি সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সমর্থন ও অংশগ্রহণের খবরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তীব্র আবেগ এবং অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে স্বাধীনতাকামী জনগণ।

শেখ মুজিব ২৫শে মার্চ রাতে সহকর্মীদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে জানিয়ে নিজে আত্মগোপন না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন, যা মওদুদ আহমদ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মওদুদ আহমদ তাঁর বইতে লেখেন, শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আমাকে সবাই চেনে। আমাকে গ্রেফতার করা হলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বিষয়টি গ্রহণ করবে। কিন্তু তোমাদের কেউ চেনে না। কাজেই তোমাদের অবশ্যই কৌশলী হতে হবে।” জে. এন. দীক্ষিতের মতে, শেখ মুজিব ভেবেছিলেন যে, তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে, মুজিব মনে করতেন যে, যদি তিনি আত্মগোপন করেন, তাহলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর জনগণের ওপর আরও ভয়াবহ অত্যাচারে মেতে উঠবে।

শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি কারাবরণ করাকেই যৌক্তিক মনে করেছিলেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেফতার করার পর ১০ই এপ্রিল ঘোষণা করা হয় যে, শেখ মুজিব তাঁদের হাতে বন্দি।

এদিনের ঘোষণা এবং করাচি বিমানবন্দরে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর, বাঙালিরা নিশ্চিত হয় যে, তিনি বেঁচে আছেন এবং এ বিষয়ে তারা কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাত ১টা থেকে ১:৩০টার মধ্যে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারের তিন দিন পর, ২৯শে মার্চ বিমানযোগে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ) জেলে আটক রাখা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু:

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পথপ্রস্থার সূচনা ঘটে এই দিনে। মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা গ্রেফতার হন, কিন্তু তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার কাজ চালিয়ে যান। ২৬ মার্চ সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে গণহত্যা শুরু করে, যা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।

জাতীয় চেতনা এবং প্রতিরোধের আহ্বান:

এই দিনটি বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিরোধের সূচনা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ করা হয়, ২৬ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার এবং চেতনা ছড়িয়ে দেয়।

গণহত্যা ও পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ:

২৬ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়, বিশেষ করে ঢাকায়, যেখানে অনেক ছাত্র, নেতা এবং সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। এই গণহত্যার উল্লেখও পাঠ্যপুস্তকে করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা জানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি।

জয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম:

এই দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক রূপ ও লক্ষ্যকে মূর্ত করে। পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়, ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পথ উন্মুক্ত হয়, যা ৯ মাস পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি লাভ করে।

এই সমস্ত বিষয়গুলো ২৬ মার্চের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরে।

উপসংহার

২৬ মার্চের প্রসঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে যে তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু হওয়ার দিন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “বাংলাদেশ স্বাধীন” ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়, যা পরে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে।

পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এর মাধ্যমে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে।

এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গর্বের এবং শোকের দিন, কারণ এটি একদিকে স্বাধীনতার সূচনা, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ফলে দেশজুড়ে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছিল। ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত করা হয়, যাতে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ এবং বিজয়কে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top