চরম আবহাওয়ার প্রভাবে শিক্ষাখাত

চরম আবহাওয়ার প্রভাবে শিক্ষাখাত

চরম আবহাওয়ার কারণে মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবন ও জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘জাতিসংঘের শিশু তহবিল’ (ইউনিসেফ)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিশুদের শিক্ষা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আজ ২৩ মার্চ, ‘বিশ্ব আবহাওয়া দিবস’। বিরূপ আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষাখাতে ব্যাপকভাবে পড়েছে। চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট রিপোর্ট’ এ বলা হয়েছে, চরম আবহাওয়ার কারণে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেকর্ড উষ্ণতম এবং ক্ষয়ক্ষতির বছর। চরম আবহাওয়ার প্রভাবে মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবন ও জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সম্প্রতি ‘জাতিসংঘের শিশু তহবিল’ (ইউনিসেফ)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিশুদের শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে।

২০২৪ সালে প্রায় ১৩ কোটি শিশু তাদের পড়ালেখায় বিঘ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি অপর প্রতিবেদন জানিয়েছে, ২০২২ সালে চরম আবহাওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর বিদ্যালয় একাধিকবার স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। বাংলাদেশেও গত বছরের এপ্রিল মাসে তীব্র দাবদাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। দাবদাহের ফলে হিটস্ট্রোকের কারণে শিশু শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থী তাদের পড়ালেখায় স্বাভাবিক মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। ২০২৩ সালের জুন মাসে, তীব্র গরমের কারণে কিছু দিন জন্য মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছিলো।

চরম আবহাওয়ার প্রভাব তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিক্ষাখাত রেহাই পাচ্ছে না। এলোমেলো বর্ষার ভরা মৌসুমে একদিকে যেমন বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হচ্ছে আবার গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহজনিত কারণেও বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বন্যার সময় দূর দূরান্তের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। উপকূলের জেলাগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের না যেতেই দারিদ্র্যের কবলে পড়ে বিদ্যালয় ছাড়ছে। দূরন্তপনা শেষ না হতেই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সুন্দরবন সংলগ্ন শিশুরা বিদ্যালয় ছেড়ে মাছ-কাঁকড়া ধরা, চিংড়ির রেণু সংগ্রহ, মধু সংগ্রহ ও ইটভাটার মতো কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শিশুরা। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ার কারণে উপকূল বিপর্যস্ত।

কেননা উপকূলে প্রথম পর্যায়ের কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কোনো স্থায়ী কর্মসংস্থান নেই। শিশু বয়স থেকে অনেককেই বিদ্যালয় ছেড়ে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। উপকূলে চরম আবহাওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত ভাঙন এবং পুনর্গঠন চলছে। প্রকৃতির এই ভাঙা-গড়া খেলায় উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষতচিহ্ন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। রোগ-বালাই এবং শারীরিক সমস্যা জর্জরিত করছে উপকূলের মানুষের জীবন। যেখানে পরিবারের অভিভাবকদের আয়-রোজগারের কথা, সেখানে তারা চরম আবহাওয়ার প্রভাবে নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর ফলে, যে বয়সে শিশুরা বিদ্যালয়ে থাকার কথা, সে বয়সেই তাদের পড়ালেখা ছেড়ে পরিবারের প্রয়োজনে আয়-রোজগারের কাজে যুক্ত হতে হচ্ছে।

ইউনিসেফের অপর এক প্রতিবেদন মতে, ১ কোটি ২০ লাখ শিশু বন্যাপ্রবণ এলাকার কাছাকাছি বসবাস করে, ৪৫ লাখ শিশু ঘূর্ণিঝড়পূর্ণ এলাকায় বসবাস করে ও খরাপ্রবণ এলাকায় বসবাস করে প্রায় ৩০ লাখ শিশু। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিত এক তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৪৯২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪ হাজার ৫০০ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়, প্রায় ১ হাজার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ২ হাজারের বেশি কলেজসহ শত শত মাদ্রাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার কারণে গত বছরে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন পিছিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ২০২৪ ও ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮৫ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ধরে শিক্ষাবর্ষ ঠিক করা হয়। বছরের এই শিক্ষাবর্ষ আন্তর্জাতিক মানের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশে শিক্ষাবর্ষ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গ্রীষ্মকালীন ছুটি সাধারণত বর্ষাকালের মধ্যে দেয়া হয়। অথচ এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে, ফলে গ্রীষ্মকালেই বিদ্যালয় বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল মাসটি উষ্ণতম মাস হয়ে থাকে, তাই এপ্রিল-মে মাসে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেয়া বাঞ্চনীয়। এভাবে, শিক্ষার্থীরা গরমের কারণে স্কুলে যেতে কষ্ট পাবেন না এবং গরমের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে না, ফলে তারা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারবে।

শিক্ষার ওপর জলবায়ুর প্রভাব হ্রাস করতে এবং জলবায়ুসৃষ্ট পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করা অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে হলে, অবকাঠামোগত সক্ষমতা এবং স্থানীয় পরিবেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষভাবে উপকূলীয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া, জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ এবং প্রকৃতির অস্থিরতা লক্ষ্য রেখে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার চিহ্নিতকরণ এবং পৃথক শিক্ষা ক্যালেন্ডার তৈরি করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এর মাধ্যমে, বিভিন্ন এলাকার পরিবেশগত চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং তাদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।

চরম আবহাওয়া শিক্ষাখাতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

চরম আবহাওয়া যেমন তীব্র গরম, বৃষ্টিপাত, বন্যা, বা ঘূর্ণিঝড় শিক্ষার কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এই ধরনের প্রভাবের ফলে বিদ্যালয় বন্ধ হতে পারে, শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না এবং শিক্ষা কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে।

কী কারণে চরম আবহাওয়া শিশুদের পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে?

চরম আবহাওয়া শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা তাদের পড়ালেখার মনোযোগ এবং সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গরমের কারণে শিশুরা অসুস্থ হতে পারে, যা বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কমায়।

উপকূলীয় এলাকায় চরম আবহাওয়া কীভাবে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে?

উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং তীব্র তাপদাহের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় বন্ধ থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না এবং তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হয়।

শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত?

স্কুলগুলোকে চরম আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, যেমন উন্নত বায়ুচলাচল ব্যবস্থা, গরমে ক্লাসের সময় পরিবর্তন, এবং জরুরি তহবিল সরবরাহ। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পৃথক শিক্ষা ক্যালেন্ডার তৈরির প্রস্তাব করা যেতে পারে।

উপসংহার

উপসংহার হিসেবে বলা যায়, চরম আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শিক্ষাখাতে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, উপস্থিতি, এবং পড়ালেখার মানে গুরুতর বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে এই প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই শিক্ষার ক্ষতি হ্রাস করতে এবং শিশুদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে অভিযোজন পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত অবকাঠামো প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে পৃথক শিক্ষা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন, এবং জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি নেয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাখাতের স্থিতিশীলতা ও শিশুশিক্ষার উন্নতির জন্য এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে শিক্ষা খাতে চরম আবহাওয়ার প্রভাব কমাতে সহায়তা করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top