শহীদদের ঋণ শোধ হবার নয়

শহীদদের ঋণ শোধ হবার নয়

সেদিনের ঘটনার ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। সুতরাং সে বিষয়ে পুনরালোচনা করে সময় অপচয় করা যথাযথ বলে মনে হচ্ছে না। আমরা প্রায়শই “একুশের চেতনা” শব্দযুগল ব্যবহার করি, কিন্তু আসলেই কি জানি এর প্রকৃত অর্থ কী? সংক্ষেপে বললে, অত্যাচার ও শোষণের কালো শৃঙ্খল ভাঙার অদম্য শক্তি এবং প্রেরণা এই একুশের অবিনাশী চেতনাতেই নিহিত। বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মপরিচয়ের উত্থানের মূল প্রেরণা একুশে ফেব্রুয়ারি। এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, একুশের রক্তস্নাত পথ ধরেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা উড়েছে।

আজ আমরা যখন মনের আনন্দে কথা বলছি, মাতৃভাষায় পড়ছি এবং ভাবনাগুলোকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করছি, তখন কি ভেবেছি, ’৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই অকুতোভয় তরুণরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় না নামলে তা সম্ভব হতো? একবার ভাবুন, যদি স্কুল-কলেজে উর্দু শেখা বাধ্যতামূলক করা হতো, গ্রামবাংলার অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষকে অফিস বা আদালতে ভাঙা উর্দুতে কথা বলতে বাধ্য করা হতো, কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতেন—তাহলে পরিস্থিতি কতটা অসহনীয় হয়ে উঠত?

আজকের দিনে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করেও যেখানে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না, সেখানে উর্দুর মতো আরেকটি ভাষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হলে আমাদের অবস্থা কতটা শোচনীয় হতো, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এমনই এক অন্ধকার ভবিষ্যতের হাত থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কয়েকজন তরুণ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা মাতৃভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার পেয়েছি।

ভুলে গেলে চলবে না যে, একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির গৌরব ও বেদনার ইতিহাস। দিনটি রক্ত দিয়ে রাঙানো, যা আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে রয়েছে। প্রতিবছর আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি এবং একটি গান গেয়ে শহিদদের স্মরণ করি। কিন্তু, শুধু এই আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেই কি বাঙালির সন্তান হিসেবে আমাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায়?

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা। তাই সেই পাঠের পুনরালোচনা করে সময় অপচয় করার প্রয়োজন নেই। আমরা প্রায়শই “একুশের চেতনা” শব্দযুগল ব্যবহার করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ শব্দ দুটি কী বোঝায়? সংক্ষেপে বললে, অত্যাচার ও শোষণের শৃঙ্খল ভাঙার অদম্য শক্তি ও প্রেরণা নিহিত আছে একুশের অবিনাশী চেতনায়। বাঙালি জাতির স্বজাত্যবোধের উন্মেষ ঘটেছে এই একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে। এবং এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, একুশের রক্তস্নাত পথ ধরেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা উড়েছিল।

এই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের প্রতিটি কাজে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীন চিন্তাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলাই হবে একুশের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন।

শহিদদের ঋণ বলতে কী বোঝায়?

শহিদদের ঋণ বলতে বোঝায় মাতৃভাষা এবং স্বাধীনতার জন্য যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ থেকে আমরা যে অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছি, সেটির প্রতি আমাদের চিরকালীন ঋণ। এটি কেবল স্মরণীয় নয়, বরং দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মাধ্যমে আমরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি।

আমরা কীভাবে শহিদদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি?

শুধু আনুষ্ঠানিক স্মরণ অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে মাতৃভাষা চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা এবং ন্যায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করাই শহিদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উপায়।

শহিদ দিবস পালনের তাৎপর্য কী?

শহিদ দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা তাদের আত্মত্যাগের মহিমা স্মরণ করি। এটি আমাদের জাতির আত্মপরিচয় এবং ভাষার মর্যাদা রক্ষার চেতনা দৃঢ় করার একটি সুযোগ।

একুশের চেতনার মূল বার্তা কী?

একুশের চেতনার মূল বার্তা হলো অন্যায়, শোষণ এবং ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অদম্য সাহস। এটি জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের উদাহরণ।

শহিদদের স্মরণ শুধু ফেব্রুয়ারিতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত কি?

কখনই নয়। শহিদদের আত্মত্যাগের চেতনা বছরের প্রতিটি দিন হৃদয়ে ধারণ করা উচিত। আমাদের প্রতিদিনের আচরণ, ভাষা চর্চা এবং নৈতিক দায়িত্বের মধ্য দিয়ে শহিদদের প্রতি ঋণ স্বীকার করতে হবে।

উপসংহার

শহিদদের ঋণ কখনোই শোধ হবার নয়, কারণ তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীন সত্তা, মাতৃভাষার অধিকার এবং জাতিগত মর্যাদার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদরা শুধু ভাষার জন্য জীবন দেননি, তাঁরা আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানাতে হলে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার চেতনা রক্ষা করতে হবে। এটি শুধুমাত্র শহিদ দিবসের আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং প্রতিদিনের জীবনে তাঁদের ত্যাগের মহিমা ধারণ করার মাধ্যমে আমরা তাঁদের ঋণ কিছুটা হলেও স্বীকার করতে পারি। একুশের চেতনাই আমাদের ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top