দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট এবং বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবইগুলি অত্যধিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এসব বইয়ের মধ্যে মোল্লা প্রিন্টার্স প্রকাশিত ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির দুটি বইও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

নতুন বছরের শুরুতে এখনো সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিকল্প ব্যবস্থায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তাদের ওয়েবসাইটে বইগুলোর পিডিএফ কপি আপলোড করেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সেগুলো ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। তবে বিনামূল্যের বই বিতরণে এই দেরির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু প্রকাশকরা। তারা বরাবরের মতোই চড়া মূল্যে বিক্রির জন্য বিনামূল্যের বই দোকানগুলোতে সরবরাহ করছেন।
দৈনিক আমাদের বার্তা এবং দৈনিক শিক্ষাডটকম-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট ও বাংলাবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব বইয়ের মধ্যে মোল্লা প্রিন্টার্স প্রকাশিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইও রয়েছে।
ওই বই দুটির সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হয় মোল্লা প্রিন্টার্সের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে। তবে তারা বিনামূল্যের বই দোকানে তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এসব বই স্কুল থেকেই বাজারে এসেছে।
তবে যে বই এখনো স্কুলে পৌঁছায়নি, সেগুলো কীভাবে স্কুল থেকে বাজারে গেল, এমন প্রশ্নের কোনো যথার্থ উত্তর পাওয়া যায়নি। এদিকে, একাধিক অভিভাবক দৈনিক আমাদের বার্তা-এর অফিসে ফোন করে বিনামূল্যের বই উচ্চমূল্যে কেনার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন।
প্রতিবছরই নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যায়। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। পাঠ্যবইয়ের সামগ্রিক সংশোধন, ভারতে ছাপার কার্যক্রম বন্ধ, সঠিক ইতিহাস সংযোজন এবং আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেট ভাঙার কারণে বই বিতরণে দেরি হবে বলে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দেরির বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা, এবং বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা গত দুই মাস ধরে জানিয়ে আসছেন, এবার পাঠ্যবই পেতে বিলম্ব হতে পারে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জানানো হয়েছিল যে, ছাপার কাজে দেরি হলেও অনলাইনে সব শ্রেণির পরিমার্জিত বই পিডিএফ আকারে পাওয়া যাবে। ফলে সেগুলো ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে পড়াশোনা শুরু করার সুযোগ রয়েছে।
তারপরও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতা এবং কাগজ ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট সত্ত্বেও গত ১ জানুয়ারি থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা প্রশাসন কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বই বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তবে, বিগত বছরের মতো এ বছরও বইয়ের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি ঠেকানো সম্ভব হয়নি। শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসব দোকানে যে কোনো সময় অভিযান চালানো হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬২ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই মুদ্রণের কাজ করছে এনসিটিবি। এ পর্যন্ত (৭ জানুয়ারি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে প্রায় ১১ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে।
কীভাবে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বাজারে যাচ্ছে?
বিনামূল্যের পাঠ্যবই মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা হলেও, অসাধু চক্রের হাত ধরে এগুলো বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু স্কুল বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে এসব বই দোকানে পৌঁছে দেওয়া হয়।
মোল্লা প্রিন্টার্সসহ প্রকাশনাগুলোর ভূমিকা কী?
মোল্লা প্রিন্টার্সসহ সংশ্লিষ্ট প্রকাশনাগুলো তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, বইগুলো স্কুল থেকেই বাজারে গেছে। তবে এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সরকার এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
শিক্ষা প্রশাসন জানিয়েছে, এই ধরনের বেআইনি কার্যকলাপ ঠেকাতে বই বিক্রির দোকানগুলোতে অভিযান চালানো হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত কতটুকু বই পেয়েছে?
২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য এনসিটিবি ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই মুদ্রণের কাজ হাতে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত (৭ জানুয়ারি পর্যন্ত) ১১ কোটি বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে।
অনলাইনে বই পাওয়ার কী ব্যবস্থা রয়েছে?
ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার জন্য এনসিটিবি তাদের ওয়েবসাইটে পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ কপি আপলোড করেছে। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে বিনামূল্যে বই ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে পড়াশোনা শুরু করতে পারে।
উপসংহার
বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এই উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, অসাধু চক্রের কারণে বই বাজারে বিক্রির যে অনৈতিক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আরও কঠোর নজরদারি এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা প্রয়োজন।
পাশাপাশি, প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পিডিএফ ফাইল ডাউনলোডের সুযোগ প্রদান ইতিবাচক একটি উদ্যোগ, যা সাময়িক সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, পাঠ্যবই যথাসময়ে সঠিক হাতে পৌঁছানো এবং এর অপব্যবহার রোধে সরকার, প্রকাশক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় এই ধরনের অনিয়ম রোধ করে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত।