সেই ৬৭৬ জাল শিক্ষকের সুলুকসন্ধানে ডিআইএ

সেই ৬৭৬ জাল শিক্ষকের সুলুকসন্ধানে ডিআইএ

“যেসব ব্যক্তির সনদ পূর্বে ভুয়া বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং যাদের কাছ থেকে বেতন-ভাতা ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এমন মোট ৬৭৬ জনের তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকগণের কাছ থেকে প্রাপ্তির অনুরোধ জানানো হয়েছে। আমরা নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব ও পরবর্তী সময়ভিত্তিক পৃথকভাবে তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছি। উক্ত তথ্যগুলো আমরা ইমেইলের মাধ্যমে চেয়েছি।”

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) সরকারিভাবে চিহ্নিত ৬৭৬ জন জাল সনদধারী শিক্ষকের বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিকট থেকে চেয়েছে। এসব শিক্ষক আগে থেকেই ভুয়া সনদের ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত এবং তাদের বেতন-ভাতা ফেরতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

ডিআইএ-এর পরিচালক প্রফেসর মো. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয়, সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য ও রেকর্ড ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। ‘সরাসরি বা বাহকের মাধ্যমে কোনো তথ্য বা রেকর্ড গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারণ, সরকারি নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী ২৪ মে (শনিবার) কর্মদিবস হিসেবে গণ্য হওয়ায়, নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্য প্রদানের সাত কর্মদিবসের সময়সীমা শেষ হবে আগামী বৃহস্পতিবার (৩০ মে)।

এ বিষয়ে ডিআইএ-এর যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর খন্দকার মাহফুজুল আলম বলেন, “ইতিপূর্বে যাদের সনদ ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করে সতর্ক করা হয়েছিল এবং যাদের কাছ থেকে বেতন-ভাতা ফেরতের নির্দেশনা রয়েছে, এমন ৬৭৬ জন শিক্ষকের তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকগণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাবেন। আমরা সময়সীমা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি।”

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর খন্দকার মাহফুজুল আলম জানিয়েছেন, জাল সনদের অভিযোগ থাকা শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই তখনকার কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান তখন সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল না। এ কারণেই সংশ্লিষ্টদের চাকরি আপাতত স্থগিত রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা অনলাইনের মাধ্যমে তাদের তালিকা আহ্বান করেছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই আমাদের কাছে এ তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রমার্জন দেওয়া সম্ভব কি না, তা একটি সভার মাধ্যমে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিষয়টি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনায় নেওয়ার চিন্তা করছে মন্ত্রণালয়।”

সূত্র জানায়, সারাদেশে জাল সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব বিষয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে, বিশেষ করে শিক্ষাবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল দৈনিকশিক্ষা ডটকমে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাল সনদধারী শিক্ষকদের একটি অংশকে যাচাই-বাছাই শেষে শর্তসাপেক্ষে প্রমার্জন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

জাল সনদধারী শিক্ষকদের প্রমার্জনের উদ্যোগকে দেশের অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করছেন না—সম্প্রতি দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিচালিত এক অনলাইন জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন, যেখানে মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষ এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন। অপরদিকে, ২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী কোনো মতামত দেননি।

এই জরিপটি ২২ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু হয়ে ২৪ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত দৈনিক শিক্ষাডটকমের ওয়েবসাইটে পরিচালিত হয়। অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছিল—“জাল শিক্ষকদের প্রমার্জনের উদ্যোগ আপনি সমর্থন করেন কি?” —উত্তরের বিকল্প ছিল: ‘হ্যাঁ’, ‘না’ এবং ‘মন্তব্য নেই’।

মোট ৩,৬৭৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এই জরিপে অংশ নেন। এর মধ্যে ১,২৬৪ জন ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন এবং ২,৩৩৯ জন ‘না’ ভোট দিয়েছেন। বাকি ৭৬ জন কোনো মন্তব্য দেননি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই জরিপ দেশের মানুষের সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। যদিও প্রমার্জনের বিষয়টি এখনো নীতিনির্ধারকদের আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, তবে জনমতের এই প্রবণতা ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।

স্নাতক (সম্মান ও পাস), বিএড এবং এনটিআরসিএর নিবন্ধন সনদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করে এমপিওভুক্ত হওয়া বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের উপস্থিতি প্রথমে সহকর্মীদের মধ্যেই কানাঘুষার জন্ম দেয়। পরবর্তীতে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে এবং দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ একাধিক গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে।

এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর দেশের একমাত্র শিক্ষাবিষয়ক প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ধারাবাহিকভাবে হাজার হাজার জাল শিক্ষকের নাম, পরিচয় ও জালিয়াতির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, জাল সনদের মাধ্যমে শিক্ষকতা করে কেবল চাকরিই নয়, অনেকে লক্ষাধিক টাকা বেতন-ভাতাও উত্তোলন করেছেন।

প্রকাশিত তথ্যে অপ্রস্তুত অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন, কেউ বরখাস্তও হয়েছেন। তবে, একটি বড় অংশ এখনো নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টায় রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে কিছু শিক্ষক নেতা ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা চাকরি রক্ষার চেষ্টা করছেন।

এই প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, কিছু শিক্ষক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রমার্জনের দাবি তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, “সনদের সত্যতা যাচাই না করে নাম প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে।” তারা বৈধ প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে পুরনো জাল সনদের দায়মুক্তি চাচ্ছেন এবং পূর্ণ বৈধতা দাবি করছেন।

এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে, তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে কিছু ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষ প্রমার্জনের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

কারা এই ৬৭৬ জন শিক্ষক?

এই ৬৭৬ জন শিক্ষক হচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধে ভুয়া শিক্ষাগত সনদ, বিশেষ করে স্নাতক, বিএড ও এনটিআরসিএ নিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের অভিযোগ রয়েছে। তারা অনেকেই এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি অনুদানভোগী শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন।

তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) এই শিক্ষকদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের কাছে রেকর্ড চেয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকের বেতন-ভাতা ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং চাকরি স্থগিত বা বরখাস্ত করার মতো প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

তথ্য পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে?

প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিস্তারিত তথ্য ও রেকর্ড শুধুমাত্র ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরাসরি বা বাহকের মাধ্যমে কোনো তথ্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে।

প্রমার্জনের কোনো সুযোগ থাকবে কি?

ডিআইএ সূত্রে জানা গেছে, কিছু শিক্ষক দাবি করেছেন, তারা ভুলবশত বা অনুমোদনহীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সনদ গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন বিষয়টি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে প্রমার্জনের বিষয়টি আলোচনা করছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

জনমত কী বলছে এই বিষয়ে?

দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিচালিত একটি অনলাইন জরিপে দেখা গেছে, ৬৪% অংশগ্রহণকারী জাল সনদধারী শিক্ষকদের প্রমার্জনের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। মাত্র ৩৪% এ উদ্যোগকে সমর্থন করেছেন, আর ২% কোনো মন্তব্য করেননি। এটি বিষয়টির সামাজিক ও নৈতিক গুরুত্বকেও সামনে এনেছে।

উপসংহার

শিক্ষা খাতে সচ্ছতা, ন্যায়নীতি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। জাল সনদধারী ৬৭৬ শিক্ষকের বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের চলমান অনুসন্ধান সেই চেষ্টারই অংশ। একদিকে যেমন রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির হিসাব-নিকাশ চলছে, অন্যদিকে বিষয়টি সামাজিক ও নৈতিকভাবে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

যদিও কিছু শিক্ষক প্রমার্জনের দাবি তুলেছেন, তবুও এটি একটি স্পর্শকাতর নীতিগত প্রশ্ন—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাদানে নিয়োজিতদের মধ্যে যদি জালিয়াতি প্রমাণিত হয়, তবে কীভাবে গড়ে উঠবে নৈতিকতা ও জবাবদিহির ভিত্তি?

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা যেমন ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটাবে, তেমনি ভবিষ্যতে এ ধরনের অনৈতিক প্রবণতা নিরুৎসাহিত করবে। কারণ, শিক্ষা শুধু পেশা নয়—এটি জাতি গঠনের মৌলিক ভিত্তি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top