ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়, দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানিকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে প্রাথমিক স্তরের দুই কোটি কপি পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়। এর ফলে শুধু ঢাকা ও সিউলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি, বরং অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান টিপিএস সরকারি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭টি টেন্ডারের সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়। তবে প্রায় ৫০ কোটি টাকার এই মুদ্রণ কাজ থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে একই বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নামমাত্র তদন্ত শেষে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, কোরিয়ান কোম্পানির বাংলাদেশি পার্টনার মেগাটেক জিএনবিডি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ শুরু করে। ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে লিখিত আবেদন জমা দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তৌহিদুল আবুল কালাম, যা তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান টিপিএস-কে বঞ্চিত করার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালে আহ্বান করা টেন্ডারটি ছিল ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানকে বঞ্চিত করে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ২ কোটি বই মুদ্রণের কাজ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা ট্রেডার্সকে প্রদান করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ান দূতাবাসও হস্তক্ষেপ করেছিল, তবে তৎকালীন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সাদা কাগজে চার রঙের প্রাথমিক পাঠ্যবই মুদ্রণ শুরু হয়। তখন থেকেই ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করলেও, পরবর্তীতে শুধু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই একচেটিয়াভাবে কাজ দেওয়া হয়। তবে গত বছরের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ টেন্ডারে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতে পাঠ্যবই মুদ্রণের আদেশ বাতিল করে।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ সময়ে, আওয়ামী লীগ সরকার বেক্সিমকোর মালিকানাধীন তিনটি ছাপাখানাকে পাঠ্যবই মুদ্রণের সিংহভাগ কাজ প্রদান করে। এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সদস্যরা, যারা অভিযোগ করেছিলেন যে বেক্সিমকোর লক্ষ্য ছিল কম বিনিয়োগে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। এতে সরকার পাঠ্যবই বিতরণ ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক সংকটে পড়ে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঘুরেফিরে কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ পেয়ে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে:
কৃষ্ণা ট্রেডার্স
ভিকে উদ্যোগ
গফসন
পৃতম্বরা বুকস
সুদর্শন বোর্ড অ্যান্ড পেপার মিলস
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা। তিনি বই ছাপানোর তদারকির নামে তিনবার ভারত সফর করেন। বিশেষ করে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে বই ছাপানোর তথাকথিত তদারকি করতে তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা ব্যয় করেন।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস শেষ হলেও ছাপা হয়ে দেশে পৌঁছায়নি প্রাথমিক স্তরের ৩৩ লাখ পাঠ্যবই। ভারতের মুম্বাইয়ের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ‘শীর্ষাসাই’ সময়মতো পাঠ্যবই ছেপে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। ওই শিক্ষাবর্ষে ৫৯ লাখ পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ পেয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি। তার মধ্যে মাত্র ২৬ লাখ বই সরবরাহ করেছে ২৩ জানুয়ারির পর।
এনসিটিবি জানায়, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের ৯৮ লটের মধ্যে ১৬ লটে এক কোটি ৮০ লাখ বই ছাপার কাজ পায় ভারতীয় তিনটি প্রতিষ্ঠান। সময়মতো বই দিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা ও নিম্নমানের কাগজের ছাপা হলেও তৎকালীন এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহার তদারকি প্রতিবেদনে তার উল্লেখ নেই। অথচ নারায়ণ সাহা ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে ফের ভারত ভ্রমণে গিয়ে এনসিটিবির তহবিল থেকেই খরচ করেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭২ টাকা।
কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটল?
২০১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের ২ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণের টেন্ডারে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান টিপিএস সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে কাজ দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা ট্রেডার্সকে কাজ প্রদান করা হয়। এতে দক্ষিণ কোরিয়া অসন্তোষ প্রকাশ করে, যার ফলে ঢাকা-শিউল কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান টিপিএস কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
টিপিএস এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। তবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নামমাত্র তদন্ত চালিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়।
এনসিটিবির টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম কীভাবে ঘটেছে?
২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে একই কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বারবার পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ পেয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণা ট্রেডার্স, ভিকে উদ্যোগ, গফসন, পৃতম্বরা বুকস, সুদর্শন বোর্ড অ্যান্ড পেপার মিলস। এ সময়ে দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য যোগ্য কোম্পানিগুলোকে পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহার ভূমিকা কী ছিল?
২০১৬ সালে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা। তিনি বই ছাপানোর তদারকির নামে তিনবার ভারত সফর করেন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে বই ছাপানোর তথাকথিত তদারকিতে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা ব্যয় করেন, যা অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমান সরকার এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, কোরিয়ান কোম্পানির বাংলাদেশি পার্টনার মেগাটেক জিএনবিডি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তারা ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে লিখিত আবেদন জমা দেয়। সরকার ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর আগের আদেশ বাতিল করেছে এবং বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
উপসংহার
প্রাথমিক স্তরের ২ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণের টেন্ডারে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান টিপিএসকে বঞ্চিত করে ভারতীয় কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার ঘটনায় শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে শিউলের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ-কোরিয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এনসিটিবির টেন্ডার প্রক্রিয়ার অনিয়ম এবং একই ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া কাজ পাওয়ার বিষয়টি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতার চরম ঘাটতি প্রকাশ করে। বিশেষ করে তৎকালীন সরকারের উদাসীনতা ও এনসিটিবির তদারকির নামে অনৈতিক ব্যয় তদন্তের দাবি রাখে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতে পাঠ্যবই মুদ্রণের আদেশ বাতিল করেছে এবং অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। এটি শিক্ষা খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ এবং ভবিষ্যতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য, যাতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনাম অক্ষুণ্ন থাকে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হয়।