রমজান মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা পালন করছেন। ইসলাম ধর্মের অন্যতম একটি স্তম্ভ হল রোজা। এই মাসব্যাপী মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাবার এবং পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।

রমজান মাসে বিশ্বব্যাপী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা পালন করছেন, যা ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই মাসে, মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাবার এবং পানীয় থেকে বিরত থাকেন।
যদিও দীর্ঘ সময় খাবার এবং পানীয় থেকে বিরত থাকার কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে, তবে অনেকেই এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাদ্যাভ্যাস মানিয়ে নিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এছাড়া, এই দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার কারণে অনেকেই ক্লান্তি ও অবসাদের অনুভূতি পেতে পারেন। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ রক্তে শর্করার মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য রোজা রাখা অনেক সময় কষ্টকর হতে পারে।
এখানে স্বাস্থ্যকর উপায়ে রোজা রাখার জন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বিবিসি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছে, যা অনেককেই রমজান মাসে কীভাবে সুস্থভাবে কাটাবেন তা পরিকল্পনা করতে সহায়তা করতে পারে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কিছু কার্যকর পদ্ধতি তুলে ধরা হচ্ছে, যা অনুসরণ করলে রোজা রাখার সময় স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব।
তিন ধাপে সেহরি:
১. প্রথম ধাপ – প্রোটিন: সেহরিতে এমন খাবার খান যাতে প্রোটিন বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ডিম, দই, পনির বা মাংস। প্রোটিন দীর্ঘসময় ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করবে এবং শরীরকে শক্তি দেবে।
২. দ্বিতীয় ধাপ – ফাইবার: শাক-সবজি, ফলমূল এবং অগ্রাসিত শস্য (whole grains) খান। এগুলি শরীরে পানি শোষণ করে, যা দীর্ঘ সময়ের জন্য পিপাসা কমাতে সাহায্য করে।
৩. তৃতীয় ধাপ – পানীয়: সেহরিতে প্রচুর পানি পান করুন। সুষম হাইড্রেশন সারা দিন ধরে শরীরের কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। তবে কফি বা চা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন, কারণ এগুলি শরীরের জল শোষণ কমিয়ে দেয়।
এই তিনটি ধাপ অনুসরণ করলে সেহরি খাবারটি পরিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যসম্মত হবে, যা রোজা রাখার সময় শরীরকে ভালো রাখবে
রোজাদার ব্যক্তির জন্য দিনের প্রথম আহার হলো সেহরি। এই সময়ে যে ধরনের খাবার খাওয়া হবে, তা নির্ধারণ করবে তিনি সারাদিন রোজা রাখার সময় কতটা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত বোধ করবেন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ফাদি আব্বাস পরামর্শ দিয়েছেন যে, কিছু সহজ টিপস অনুসরণ করলে দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার অভিজ্ঞতা সহজ এবং শরীরে পানিশূন্যতা কম হবে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
আব্বাস বলেছেন, সেহরিতে এমন খাবার নির্বাচন করা উচিত যেগুলোর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পানি থাকে। এর মাধ্যমে শরীরে হাইড্রেশন বজায় রাখা সম্ভব, যা রোজা রাখার সময় ক্লান্তি এবং তৃষ্ণা কমাতে সাহায্য করবে।
তার মতে, সেহরি তিনটি ধাপে খাওয়া উচিত এবং প্রতিটি ধাপের মধ্যে অন্তত পাঁচ মিনিটের বিরতি রাখা উচিত। প্রথম ধাপ হিসেবে সেহরি শুরু করা উচিত সালাদ দিয়ে, যার মধ্যে থাকতে পারে শসা, লেটুস, টমেটো ইত্যাদি। তবে, সালাদে লবণ কম ব্যবহার করতে হবে, কারণ অতিরিক্ত লবণ শরীরে পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এই পরামর্শগুলি অনুসরণ করলে সেহরির খাবারটি স্বাস্থ্যসম্মত ও কার্যকর হবে, এবং পুরো রোজা রাখার সময় শরীর সঠিকভাবে কাজ করবে।
কেননা অতিরিক্ত লবণ খেলে কিছু সময় পর শরীরের পানি চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। পনির এবং বাদামের অনেক উপকারিতা থাকলেও, এতে থাকা লবণের কারণে শরীর দ্রুত পানির প্রয়োজন অনুভব করে।
ফাদি আব্বাস পরামর্শ দিয়েছেন যে, সেহরির দ্বিতীয় ধাপে শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে দুই-তিন টুকরো বা এক কাপ তাজা ফল খাওয়া ভাল, যেগুলোর মধ্যে পানি পরিমাণ বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তরমুজ, কমলা ইত্যাদি। চাইলে এই ফলগুলো জুস করে খাওয়া যেতে পারে, তবে এক কাপ পরিমাণে।
তার পর, তৃতীয় বা শেষ ধাপে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত, যাতে সারা দিন হাইড্রেশন বজায় থাকে।
এছাড়া, রোজা রাখার সময় সেহরিতে চা এবং কফি পান করা এড়ানো উচিত, যা ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগও পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, এই পানীয়গুলো মূত্রবর্ধক (diuretic) এবং এতে ক্যাফিন থাকে, যা শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেয়। এতে শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হতে পারে, যা রোজা রাখার সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
শরীরের তরল কমে যাওয়া মানে তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন, না হলে পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) হতে পারে। এর ফলে মাথাব্যথা, নিম্ন রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই শরীরে তরলসামগ্রী যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করা জরুরি, বিশেষত রোজা রাখার সময়।
ক্লান্ত বা অলস বোধ করলে কী করবেন?
রমজান মাসে খাবারের সমাহার অনেকটাই পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। অনেক পরিবারে রোজার সময় ইফতার আয়োজন করার একটি বিশেষ রীতি থাকে, যেখানে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইফতার ভাগ করা হয়। এই অভ্যাসের মাধ্যমে প্রতিদিন নানা রকম খাবার পরিবেশন করা হয়, যার ফলে সবাই বিভিন্ন ধরনের খাবার উপভোগ করতে পারেন।
তবে, স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যেন খাবারের অতিরিক্ত পরিমাণ বা ভারী খাবার খেলে ক্লান্তি ও অলস বোধ কমে যায়। এমন খাবার নির্বাচন করা উচিত যা শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করবে এবং একই সঙ্গে শরীরকে তরল বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
এতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ইফতারে তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলেন, এবং এর ফলে তিনি শরীরের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা বুঝতে পারেন না। এই অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার কারণে পেটে ব্যথা, পেট ভার লাগা, অলসতা, ঘুমঘুম ভাব ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।
তবে, কিছু মানুষের জন্য এই সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত যদি তাদের উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে চিনির মাত্রা বেশি থাকে। অতিরিক্ত খাবারের কারণে এসব সমস্যা আরও তীব্র হতে পারে।
ফাদি আব্বাসের মতে, রোজার প্রথম কয়েক দিন সবচেয়ে কঠিন হতে পারে, কারণ শরীর শক্তির জন্য চর্বি ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরু করে প্রায় চার দিনের পর।
আব্বাস বলেন, সেহরির মতো ইফতারও তিনটি ধাপে খাওয়া উচিত, এবং প্রতিটি ধাপের মধ্যে অন্তত ছয় মিনিটের বিরতি রাখা উচিত। এর কারণ, মস্তিষ্কের কাছে পেট ভরা হওয়ার সংকেত পৌঁছাতে প্রায় ১৮ মিনিট সময় লাগে। তাই, এই সময়টুকু মাথায় রেখে খাবার পরিকল্পনা করা উচিত।
ফাদি আব্বাসের পরামর্শ
প্রথম ধাপ রোজা ভাঙার পর এক কাপ পানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটি বসে খাওয়া উচিত এবং এই পানি তিনটি ধাপে যোগ করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ ছয় মিনিট পর, আপনি শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার খেতে পারেন। তবে প্রাকৃতিক খাবার, যেমন খেজুর বা তাজা ফলের রস বেছে নেওয়া ভাল।
তৃতীয় ধাপ আরও ছয় মিনিট পর, ছোট ছোট করে কাটা সালাদ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ফাদি আব্বাস। শাকসবজি খেলে শরীর ভিটামিন পাবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ হবে।
শেষ ধাপ সালাদের পরে এক বা দুটি খাবার খেতে হবে যাতে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আলু, ভাত, রুটি, পিঠা, খিচুরি ইত্যাদি। তবে এক ধরনের খাবারই বেছে নেবেন এবং প্রোটিনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের খাবার গ্রহণ করবেন (যেমন, ডিম, চর্বিহীন মাংস, বা দুগ্ধজাত খাবার)।
ফাদি আব্বাস বলেন, খাবার চিবানোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নরম খাবার ৩০ সেকেন্ড ধরে চিবিয়ে খাওয়া উচিত, আর শক্ত খাবার যেমন মাংস বা বাদাম এক মিনিট ধরে চিবিয়ে খাওয়া উচিত।
পানির বিষয়ে: শরীরের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি প্রয়োজন হলেও একবারে অনেক পানি খাওয়া শরীরের অন্ত্র ও কিডনির কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই একবারে দুই কাপের বেশি পানি খাওয়ার বদলে প্রতি ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পর পর পানি পান করতে হবে। পানি পান করার সময় মনে রাখতে পারেন, আপনি একটি অ্যালার্ম সেট করতে পারেন যাতে নিয়মিত পানি পান করার কথা মনে থাকে।
এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে, রোজা রাখার সময় শরীর ভালো থাকবে এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা কম হবে।
সেহরি ও ইফতার সুষমভাবে গ্রহণ করুন:
সেহরি ও ইফতার সময় সুষম খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। সেহরিতে এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন, যাতে প্রোটিন, শর্করা, এবং ফাইবার থাকে। এই ধরনের খাবার ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করবে এবং তৃষ্ণাও বেশি অনুভূত হবে না।
ইফতারে সালাদ, তাজা ফল, এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়া উচিত।
পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করুন:
সেহরি ও ইফতার সময় পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যাতে শরীর ডিহাইড্রেটেড না হয়। পানি খাওয়ার জন্য একাধিক ধাপে পানি পান করুন এবং একবারে অনেক পানি না খেয়ে ধীরে ধীরে পান করুন।
চা বা কফি এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো মূত্রবর্ধক এবং শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেয়।
পানি শোষণকারী খাবার খাওয়া:
সেহরিতে এমন খাবার খেতে হবে যেগুলোর মধ্যে পানি পরিমাণ বেশি, যেমন তরমুজ, শসা, লেটুস, বা কমলা। এগুলি শরীরের পানির চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে এবং তৃষ্ণা কমাবে।
খাবার ধীরে ধীরে খান:
ইফতারে খাবার খাওয়ার সময় ধীরেস্থিরে খেতে হবে এবং একাধিক ধাপে খাবার গ্রহণ করা উচিত। খাবার খাওয়ার মধ্যে ৫-১০ মিনিটের বিরতি রাখুন, কারণ আপনার পেট ভরেছে কিনা মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে সময় লাগে। এটি ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করবে।
ফ্যাট ও লবণ কম খাওয়ার চেষ্টা করুন:
সেহরিতে বা ইফতারে অতিরিক্ত লবণ বা ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলি শরীরে পানি শোষণের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং তৃষ্ণা বাড়ায়।
এই টিপসগুলো অনুসরণ করলে রোজা রাখার সময় ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি কমাতে সহায়তা পাওয়া যাবে।
উপসংহার
রোজা রাখার সময় শরীরের সঠিক যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত ক্ষুধা ও তৃষ্ণা অনুভব করা এড়াতে। সুষম খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা, এবং খাবারের ধাপগুলোর মধ্যে যথাযথ বিরতি রাখা শরীরকে শক্তি প্রদান করতে সহায়ক। সেহরি ও ইফতার সময় প্রাকৃতিক খাবার বেছে নেওয়া, যেমন ফল, শাকসবজি, এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার শরীরকে সঠিকভাবে পুষ্টি প্রদান করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া, খাবার খাওয়ার পর ধীরে ধীরে বিশ্রাম নেওয়া এবং অতিরিক্ত লবণ বা ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা শরীরের পানির চাহিদা মেটাতে সহায়ক।
এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে রোজা রাখার অভিজ্ঞতা আরও সুস্থ, সুষম এবং আরামদায়ক হবে, এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি অনেকটা কমে যাবে।




