ভালো বেতন নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষকরা আদর্শ ও নৈতিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হবেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।

ভালো বেতন পেলে শিক্ষকরা আদর্শবান ও নৈতিক থাকতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
শনিবার (১ নভেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) কখনও বলেনি যে শিক্ষায় একটি দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। বরং উদ্দেশ্য হলো—শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে শিক্ষকরা আদর্শবান থাকতে পারেন। কারণ, শিক্ষক সমাজ নষ্ট হলে একটি জাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে—এর বাস্তব উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ।
অধ্যাপক মামুন আরও বলেন, দেশের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড এখনো ১৩তম, অর্থাৎ তারা সরকারি চাকরিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত। অথচ অধিকাংশ শিক্ষকই স্নাতক কিংবা মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। বর্তমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী তাদের মূল বেতন মাত্র ১১ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে সর্বমোট মাসিক আয় প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ টাকা।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ২০১৫ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের দৈনিক টিফিন ভাতা সাড়ে ৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে—বর্তমান বাজারে এমনকি তখনকার দরে এই টাকায় কি একটি টিফিনও সম্ভব ছিল?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, ২০১৫ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী বাংলাদেশের পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদ ১০ম গ্রেডে রয়েছে। একইভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরাও ১০ম গ্রেডভুক্ত। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “পুলিশের এসআই ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক—উভয়ের বেতন গ্রেড একই হলেও তাদের জীবনযাত্রার মান কি এক?”
তিনি বলেন, পুলিশের এসআই পদে যারা নিয়োগ পান, তাদের অনেকের গাড়ি-বাড়ি রয়েছে এবং তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। যদিও তাদের প্রকৃত বেতন তেমন বেশি নয়, তবু বিভিন্ন উপায়ে তারা অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ পায়। কিন্তু শিক্ষকদের সে সুযোগ নেই। অনেকে প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং করিয়ে সামান্য অতিরিক্ত আয় করেন, তবে প্রাথমিক শিক্ষকদের সে সুযোগও খুব সীমিত। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তরে অবস্থান করছে।
অধ্যাপক মামুন আরও বলেন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাধারণত ১১তম গ্রেড (মূল বেতন ১২,৫০০ টাকা) থেকে শুরু করে পদোন্নতি ও বিএড ডিগ্রির ভিত্তিতে ১০ম গ্রেডে (মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা) উন্নীত হতে পারেন। কিন্তু এই শিক্ষকরা ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারেন না। তাই অনেকে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থার মান ভয়াবহভাবে নেমে গেছে।
তিনি বলেন, “প্রাইভেট ও কোচিং সংস্কৃতি এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে, শিক্ষকরা এখন শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিয়ে পড়ান না। ফলে শিক্ষার্থীরা যেই সময়ে খেলাধুলা বা সৃজনশীল কাজে যুক্ত হতে পারতো, সে সময় প্রাইভেট বা কোচিংয়ে কাটায়। অভিভাবকরা অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় করছেন, আর শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের এই ধান্দাবাজি বুঝে ফেলছে। এর ফলে পুরো জাতি এক ধরনের ধান্দাবাজ মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
ঢাবির এই অধ্যাপক আরও বলেন, “ইউনেস্কো এমনি এমনি শিক্ষায় একটি দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে না। এর যৌক্তিক কারণ হলো—শিক্ষকদের ভালো বেতন নিশ্চিত করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা, যাতে শিক্ষকরা আদর্শবান থাকতে পারেন। শিক্ষক সমাজ নষ্ট হলে দেশ ধ্বংসের মুখে পড়ে—এর বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশ।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমি আশা করেছিলাম এই সরকার অন্তত একটি ভালো কাজ করে যাবে—সেটা হলো শিক্ষার আমূল সংস্কার। কারণ রাজনৈতিক সরকার এলে তারা কখনোই শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন আনবে না। যদি এই সরকার বড় কোনো সংস্কার করে যেতে পারতো, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারও তা সহজে পরিবর্তন করতে পারতো না।”

টি সাধারণ প্রশ্নোত্তর
কে এই মন্তব্য করেছেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এই মন্তব্য করেছেন।
তিনি কোথায় এ মন্তব্য করেন?
শনিবার (১ নভেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক মামুনের বক্তব্যের মূল বিষয় কী?
তিনি বলেন, শিক্ষকদের ভালো বেতন নিশ্চিত করা গেলে তারা আদর্শবান ও নৈতিক থাকতে পারেন, যা একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি কেন ইউনেস্কোর ৬% জিডিপি বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন?
তিনি জানান, ইউনেস্কোর এই সুপারিশের উদ্দেশ্য শুধু সংখ্যাগত নয়, বরং শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করা।
শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি কী বলেছেন?
অধ্যাপক মামুন বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুবই কম। তারা ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারেন না, ফলে অনেকেই প্রাইভেট বা কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন—যা শিক্ষাব্যবস্থার মান নষ্ট করছে।
উপসংহার
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নির্ভর করে শিক্ষকদের আর্থিক ও নৈতিক স্থিতির ওপর। ভালো বেতন ও উপযুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষকরা আদর্শবান থাকতে পারেন, যা একটি জাতিকে সৎ, শিক্ষিত ও উন্নত পথে পরিচালিত করে। তাই শিক্ষার আমূল সংস্কার ও শিক্ষকদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এখন সময়ের দাবি।




