গত ১৯ ডিসেম্বর জারি করা নীতিমালার আলোকে একই সেবা খাতে, একই টেবিলে বসে কাজ করা কর্মীদের মধ্যে কারো বদলি কার্যকর হবে, আবার কারো হবে না—এটি স্পষ্টতই নীতিবিরোধী। এই নীতিমালা নিজেই ন্যায্যতার পরিপন্থী। কোনো সচেতন ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি এটি গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারেন না।
সম্প্রতি জারি হওয়া বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির নীতিমালাকে চরম নীতিবিরোধী এবং বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করে তা দ্রুত সংশোধনের আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল শনিবার দৈনিক শিক্ষাডটকম কনফারেন্স হলে আয়োজিত “বেসরকারি শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলি নীতিমালা” শীর্ষক টকশোতে শিক্ষাবিদরা এই দাবি উত্থাপন করেন।
টকশোতে বক্তারা উল্লেখ করেন, গত ১৯ ডিসেম্বর জারি করা নীতিমালার আওতায় একই সেবাখাতে, একই টেবিলে কাজ করা সত্ত্বেও কোনো শিক্ষক বদলির সুযোগ পাবেন, আবার কেউ তা পাবেন না। এটি স্পষ্টতই বৈষম্যমূলক এবং নীতির পরিপন্থী। এই ধরনের নীতি কোনো ন্যায্য বা বিবেকবান ব্যক্তি মেনে নিতে পারেন না। তারা আরও বলেন, এই নীতির মাধ্যমে চরম বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে এবং বেসরকারি শিক্ষকদের সাথে অযাচিত আচরণ করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বক্তারা সরকারকে আহ্বান জানান, অবিলম্বে এই নীতিমালা প্রত্যাহার করে একটি সর্বজনীন এবং ন্যায়সংগত বদলি নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্য।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের আয়োজনে অনুষ্ঠিত টকশোর প্রথম পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সাবেক বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক মোজাহার হোসেন এবং শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রিন্স। টকশোর সঞ্চালনা করেন দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার লীড রিসার্চার এবং ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মাছুম বিল্লাহ।
টকশোতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, “একই যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার অধিকারী হয়ে একই শিক্ষাক্রমে পাঠদান করানোর পরও কেউ বদলি হওয়ার সুযোগ পাবেন, আবার কেউ পাবেন না—এটি একেবারেই বৈষম্যমূলক। এই নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষকদের মধ্যে চরম বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই চরম নীতিবিরোধী নীতিমালা দ্রুত সংশোধন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য সুবিচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এটি শুধু ন্যায়ের প্রশ্ন নয়, শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।”
শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রিন্সও বদলি নীতিমালাকে বৈষম্যমূলক হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং দ্রুত এটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ ডিসেম্বর জারি করা বদলি নীতিমালায় এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত নারী শিক্ষকদের জন্য তিনবার এবং পুরুষ শিক্ষকদের জন্য কর্মজীবনে দুইবার বদলির সুযোগ রাখা হয়েছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যারের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে চলতি বছরের ১ আগস্ট জারি করা পূর্ববর্তী নীতিমালা বাতিল করা হয়। নতুন নীতিমালায় সরাসরি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এনটিআরসিএর সনদ ব্যবহার করে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বদলির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে শিক্ষক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
এই প্রেক্ষাপটে দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার আয়োজিত টকশোতে শিক্ষকরা তাদের সীমাহীন কষ্টের কথা তুলে ধরেন। দাউদকান্দির পিপাইয়া কান্দি আমানুল উলুম সিনিয়র মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক রাশিদা আক্তার নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা ও বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করেন। সিরাজগঞ্জের ছাতিয়ানতলী মোড়গ্রাম টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর মো. আতিকুল ইসলাম নীতিমালার ৭ নম্বর ধারার অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেন। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের উজান গোবিন্দী বিনাইরচর উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম চাকরির দূরত্বজনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি জানান, বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি সর্বজনীন, ন্যায়সঙ্গত এবং বৈষম্যহীন বদলি নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হোক।
কুমিল্লার মুরাদনগরের সহকারী শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম টকশোতে বদলির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। সিলেটের পশ্চিম জাফলং উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক বশির আহমেদ দূরের চাকরির কারণে তার ভোগান্তির কথা বর্ণনা করেন।
টকশোতে আরও অংশগ্রহণ করেন ঢাকার মাদারটেক আবদুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন চৌধুরী এবং মাদারীপুরের সহকারী শিক্ষক আব্দুর রহমান বাহার।
পাদটীকা: টকশোতে আলোচনা করা বিষয়গুলো শিগগিরই বিস্তারিত আকারে দৈনিক আমাদের বার্তা এবং দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশিত হবে।
শিক্ষাসহ সর্বশেষ খবর পেতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকুন। নতুন ভিডিও মিস করতে না চাইলে এখনই চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটনে ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করলে আপনার স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
বেসরকারি শিক্ষক বদলি নীতিমালার মূল সমস্যাটি কী?
বর্তমান বদলি নীতিমালায় এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য সীমিত বদলির সুযোগ রাখা হয়েছে। নারী শিক্ষকদের জন্য তিনবার এবং পুরুষ শিক্ষকদের জন্য দুইবার বদলির সুযোগ দেওয়া হলেও সরাসরি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এটি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি করছে।
কেন এই নীতিমালাকে বৈষম্যমূলক বলা হচ্ছে?
একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও শিক্ষকরা বদলির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্তরা সুবিধা পেলেও সরাসরি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরা এ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি শিক্ষকদের জন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অযাচিত বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষকরা নীতিমালায় কী ধরনের সংশোধন দাবি করছেন?
শিক্ষকরা একটি সর্বজনীন এবং ন্যায়সঙ্গত বদলি নীতিমালা প্রণয়নের দাবি করছেন, যা সকল বেসরকারি শিক্ষকের জন্য প্রযোজ্য হবে। তারা চান, বদলির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না রেখে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হোক।
নীতিমালার বর্তমান প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে?
বর্তমান নীতিমালায় স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলির আবেদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। তবে এই প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র এনটিআরসিএ সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, যা অন্য শিক্ষকদের বাইরে রেখে বৈষম্য তৈরি করেছে।
কেন সর্বজনীন নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ?
সর্বজনীন নীতিমালা শিক্ষকদের মধ্যে ন্যায্যতা, সম্মান এবং সমতা নিশ্চিত করবে। এটি চাকরির পরিবেশকে উন্নত করবে এবং শিক্ষকদের পেশাগত জীবনে স্থিতিশীলতা আনবে। কোনো ধরনের বৈষম্য বা বিভাজন ছাড়া একটি সবার জন্য গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন শিক্ষা খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শিক্ষকদের এ দাবির সঙ্গে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক নেতা এবং অভিভাবকরাও একমত পোষণ করেছেন এবং অবিলম্বে নীতিমালা সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন।
উপসংহার
বেসরকারি শিক্ষক বদলি নীতিমালা সংশোধন ও সর্বজনীন করার দাবি বর্তমানে শিক্ষা খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিদ্যমান নীতিমালায় শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি হয়েছে, যা শুধু পেশাগত ন্যায়বিচার নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নের জন্যও বাধা। একটি ন্যায়সঙ্গত, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন বদলি নীতিমালা প্রণয়ন শিক্ষকদের পেশাগত সম্মান রক্ষা এবং কাজের পরিবেশ উন্নত করতে সহায়তা করবে।
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষকদের দাবিগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে সমতা, সুবিচার এবং পেশাগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। এটি শুধু শিক্ষকদের জন্য নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হবে।




