রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত ৩২ বছর ধরে ৪৯৫টি বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজের প্রায় ৩,৫০০ জন নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক বৈষম্যের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে, এবং এমপিওভুক্ত না করেই তাঁদের অবস্থান করা হয়েছে, যা তাঁদের জীবনে অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
এমপিওভুক্তির দাবিতে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে এবং বিধি মোতাবেক নিয়মিত নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষকদের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
রোববার (২৭ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তাঁদের এই দাবি তুলে ধরেন এবং ঢাকার শিক্ষা ভবনের সামনে শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানান।

তারা বলেন, “আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজের অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষক। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদেরকে বেতন-ভাতা না দিয়ে এমপিওবিহীন রেখে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছি।”
তারা আরও বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সারাদেশে বেসরকারি কলেজগুলোর লক্ষ লক্ষ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। তবে, পূর্ববর্তী সরকারগুলো আমাদের—অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের—জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেনি, যার কারণে আমরা এমপিওভুক্ত হতে পারিনি। আর অন্যদিকে, আমাদেরকে প্যাটার্ন বহির্ভূত শিক্ষক হিসেবে কলেজগুলো থেকে যে পূর্ণস্কেল বেতন দেওয়ার কথা, সেটাও পাচ্ছি না। কলেজভেদে মাসে ২০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার বেশি কিছুই পাচ্ছি না।”
এছাড়া, করোনা মহামারীর সময় থেকে অধিকাংশ কলেজে বেতন বন্ধ ছিল বলে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, “তবে, একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েও রাজনৈতিক বিবেচনায় সদ্য জাতীয়করণ হওয়া ৩০২টি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকরা ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডারভুক্ত হয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এমনকি, ডিগ্রিস্তরের ৩য় শ্রেণির শিক্ষকরা, যারা জনবল কাঠামোয় নেই, তারাও এমপিওভুক্ত হতে সক্ষম হয়েছেন।”
শিক্ষক নেতারা আরও জানান, “১৯৯৩ সালে টাঙ্গাইলের বিজিবি কলেজের ৮ জন অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষককে বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। আর অন্যদিকে, ফাজিল ও কামিল (মাস্টার্স সমমান) শ্রেণির শিক্ষকরা, যারা জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।”
এই বৈষম্য এবং অবহেলার বিরুদ্ধে শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছেন।
অথচ, বেসরকারি কলেজগুলোর অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা এনটিআরসিএ সনদধারী হওয়ার পরও, জনবল ও এমপিও নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তারা এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না। এটি একদিকে যেমন চরম বৈষম্য, অন্যদিকে দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারবিরোধী।
তাদের দাবি, “বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য, বিগত সরকারের বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একাধিক নির্দেশনা, নবম ও দশম সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর অধ্যায়-০৮-এ বর্ণিত উচ্চশিক্ষার কৌশল বাস্তবায়নের জন্য এ সব শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল।”
তারা আরও জানান, “আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে, বিধি অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত এবং নিয়মিত এসব শিক্ষককে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত করা হোক।”
তারা আরও উল্লেখ করেন, “যদি প্রতি মাসে ৯ কোটি এবং বছরে ১০৮ কোটি টাকার বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়, তবে এমপিওভুক্তির ন্যায়সঙ্গত দাবির বাস্তবায়ন সম্ভব।”
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন—কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. মোস্তফা, জেলা কমিটির সভাপতি নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সোহেল, মাহবুবুর রহমান, নুর নবী, আব্দুস সালাম, ইয়াসীন, মাহমুদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল মামুন, রোমেন দে, মুক্তা দাশ প্রমুখ।
এমপিওভুক্তির দাবি কী এবং কেন অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা এই দাবি করছেন?
এমপিওভুক্তির দাবি হচ্ছে, সরকারি বেতন-ভাতা ও সুবিধা প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে নিয়োগপ্রাপ্ত, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা শিক্ষকদের এমপিও (মাসিক পেমেন্ট অর্ডার) সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি। অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা তাদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করেও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যার ফলে তারা চরম আর্থিক অসুবিধায় ভুগছেন। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে তাদের বেতন, পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত হবে
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি শিক্ষকদের জন্য একটি দ্রুত এবং কার্যকরী সমাধান হতে পারে। এটি প্রশাসনিক জটিলতা ও অযথা বিলম্ব দূর করবে এবং দ্রুত তাদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চালু করবে, যাতে তাঁরা বেতনভাতাসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা পেতে পারেন।
এমপিওভুক্ত না হওয়ার ফলে শিক্ষকরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন?
এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না এবং তাঁদের অবস্থান অসম্মানজনক। শিক্ষকদের অনেকেই নিজেদের পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খাচ্ছেন এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। এ ছাড়া, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তুলনায় তাঁরা কার্যত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
কী কারণে এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি?
শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি প্রধানত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবের কারণে। পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়েও বেশ কিছু নির্দেশনা ও সুপারিশ দেওয়া হলেও, এগুলি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
শিক্ষকরা তাদের দাবি পূরণের জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
শিক্ষকেরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, প্রেস কনফারেন্স ও মানবাধিকার কর্মসূচির আয়োজন করেছেন, যেখানে তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এমপিওভুক্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা নিলে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেটানো সম্ভব হবে।
উপসংহার
এমপিওভুক্তির দাবি শুধু শিক্ষক সমাজের জন্য একটি আর্থিক সুবিধা অর্জনের বিষয় নয়, বরং এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের অনুমোদিত বেসরকারি কলেজগুলোতে গুণগত শিক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও সুবিধা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষকরা পাবেন বেতন, পেনশন এবং অন্যান্য সরকারি সুবিধা, যা তাঁদের কর্মস্পৃহা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করার একটি কার্যকরী পথ খোলা যেতে পারে, যা শুধুমাত্র শিক্ষক সমাজের জন্যই নয়, পুরো দেশের শিক্ষা খাতের উন্নতির জন্যও উপকারী হবে। অতএব, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাদের অব্যাহত সংগ্রাম ও প্রতিবাদ থেকে স্পষ্ট যে, এই দাবির বাস্তবায়ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ করবে।




