দাম নিয়ে হতাশ, মাদরাসাগুলো সংরক্ষণ করছে চামড়া

দাম নিয়ে হতাশ, মাদরাসাগুলো সংরক্ষণ করছে চামড়া

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত এগারোটি জেলার মাদরাসা, এতিমখানা এবং লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে মোট ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬টি গরু ও মহিষের চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, ৭৪ হাজার ৩০২টি ছাগলের চামড়াও সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এ বছরও কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে মূল্য ছিল আশানুরূপ নয়। অনেক ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার চামড়া সিন্ডিকেট ভাঙার এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, দেশের বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো চামড়া বিক্রি না করে সংরক্ষণের পথে হেঁটেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাজারে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া গেলে সংরক্ষিত চামড়া পরবর্তীতে বিক্রি করা হবে। এই আয় থেকেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান, আবাসন ও খাদ্যসংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ করা হবে বলে তারা আশাবাদী। এতে করে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ঈদের তৃতীয় দিন (সোমবার) দেশের বিভিন্ন মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ১১টি জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতে এ বছর মোট ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬টি গরু ও মহিষের চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংরক্ষিত হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০২টি ছাগলের চামড়া।

কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নিয়ে দীর্ঘদিনের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এবার দেশের বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো নিজ উদ্যোগে চামড়া সংরক্ষণ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করায় এসব প্রতিষ্ঠান এবার সরাসরি চামড়া বিক্রির পরিবর্তে সংরক্ষণের পথ বেছে নেয়।

খুলনা বিভাগে অবস্থিত ১০টি জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো এবার মোট ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৪টি পশুর চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজার ১১২টি গরু ও মহিষের এবং ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮২টি ছাগলের চামড়া রয়েছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, চুয়াডাঙ্গা জেলার ১৯টি মাদরাসা ও এতিমখানা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৮২৪টি গরুর চামড়া ও ৫ হাজার ২৪৮টি ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করেছে।

জানা গেছে, কোরবানি প্রদানকারীরা প্রতিবছর পশুর চামড়া স্থানীয় মাদরাসা বা এতিমখানায় দান করে থাকেন। পূর্বে এসব প্রতিষ্ঠান চামড়াগুলো বাজারমূল্যের তুলনায় কম দামে চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হতো, কারণ চামড়া পচনশীল হওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ সম্ভব হতো না। বছরের পর বছর ধরে এই সিন্ডিকেট-নির্ভর ব্যবস্থাই চালু ছিল। এবার সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা ও লবণ সরবরাহের ফলে মাদরাসাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির চামড়ার বাজারে উল্লেখযোগ্য দাম ছিল, তখন প্রতি বর্গফুট চামড়া ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হতো। এরপর থেকে বাজারমূল্য ধারাবাহিকভাবে কমে আসতে থাকে। ২০১৯ সালে বাজারে বড় ধরনের ধস নামে, এবং অনেক এলাকায় ন্যূনতম মূল্য না পাওয়ায় চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। তখন প্রায় ২৪২ কোটি টাকার চামড়া বিনষ্ট হয়েছিল।

মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এবার সংরক্ষিত চামড়া থেকে ন্যায্য মূল্য পাওয়া গেলে, সেটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, আবাসন ও খাদ্যব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখবে এবং তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা পাবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশে ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু ও মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল ও ভেড়া, এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতির পশু।

চামড়ার মূল্য নিয়ে দীর্ঘদিনের অস্থিরতা কাটিয়ে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে সরকার এবার আগেভাগেই দর নির্ধারণ করেছে। গত ২৬ মে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে।

নির্ধারিত দর অনুযায়ী:

ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া: ৬০-৬৫ টাকা (গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা)

ঢাকার বাইরে: ৫৫-৬০ টাকা (গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা)

ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন মূল্য: ১,৩৫০ টাকা

ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন মূল্য: ১,১৫০ টাকা

ছোট প্রাণির চামড়ার জন্য নির্ধারিত দাম:

খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট: ২২-২৭ টাকা

বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট: ২০-২২ টাকা

সরকারি এই মূল্য নির্ধারণের পেছনে উদ্দেশ্য হলো বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি বা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করা এবং মাদরাসা, এতিমখানা, সাধারণ কোরবানিদাতাসহ সব পক্ষকে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

এবার কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে কেন হতাশা দেখা দিয়েছে?

চামড়ার দাম সরকারিভাবে কিছুটা বাড়ানো হলেও বাস্তব বাজারে অনেক জায়গায় তা কার্যকর হয়নি। অনেক স্থানেই ব্যবসায়ীরা নামমাত্র দামে চামড়া কিনতে চেয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মাদরাসাগুলো ন্যায্য মূল্য না পেয়ে বিক্রির বদলে সংরক্ষণের পথ বেছে নেয়।

মাদরাসাগুলো চামড়া সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে?

পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সিন্ডিকেটের কারণে তারা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার সরকার থেকে লবণ সরবরাহসহ সংরক্ষণের সহায়তা দেওয়ায় তারা বিক্রি না করে সংরক্ষণ করছে, যাতে পরে ভালো দাম পেলে বিক্রি করে শিক্ষার্থীদের খরচ চালানো যায়।

সরকার চামড়ার মূল্য কত নির্ধারণ করেছে?

ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৬০–৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা। ছাগলের ক্ষেত্রে ২০–২২ টাকা প্রতি বর্গফুট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক জায়গায় এই দর মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

কতটি চামড়া সংরক্ষণ করেছে মাদরাসাগুলো?

চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬টি গরু-মহিষের ও ৭৪ হাজার ৩০২টি ছাগলের চামড়া সংরক্ষিত হয়েছে। খুলনা বিভাগে সংরক্ষিত হয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৪টি চামড়া, যার মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজার ১১২টি গরু-মহিষের এবং ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮২টি ছাগলের চামড়া রয়েছে।

আগামীতে মাদরাসাগুলো এই চামড়া দিয়ে কী করবে?

তারা আশা করছে, উপযুক্ত সময় ও বাজার পরিস্থিতি বুঝে চামড়া বিক্রি করলে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাবে। সেই অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, খাবার ও আবাসন ব্যয় মেটানো হবে।

উপসংহার

কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নিয়ে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের বহু মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবার চামড়া সংরক্ষণের পথে এগিয়েছে। সরকারের লবণসহায়তা ও আগাম মূল্য নির্ধারণ উদ্যোগ কিছুটা সহায়ক হলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে চামড়া খাতের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে রক্ষা করা গেলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ভিত্তিও শক্তিশালী হবে, যা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top