জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনা পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্তের আহ্বান

জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনা পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্তের আহ্বান

নিপীড়ন যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হয়, তখন তার প্রভাব শুধুমাত্র ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি তার পরিবার এবং আশপাশের মানুষের জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলে।

শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) আকিজ বেকার্সের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত কর্মশালায় গুমের শিকার ব্যক্তি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য সরকারি, বেসরকারি ও পারিবারিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কর্মশালায় সরকারি প্রতিনিধি, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, জুলাই যোদ্ধা, ছাত্র ও তরুণ প্রতিনিধিসহ প্রায় ২০০ দেশি-বিদেশি অতিথি উপস্থিত ছিলেন।

বক্তারা বলেন, গুমের শিকাররা মানসিক ও সামাজিক চাপের কারণে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হন না। তাই তাদের পরিবারের কাছে সরাসরি ও প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসা পৌঁছানো অত্যাবশ্যক। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ কাস্টডিতে থাকা আহতদের ন্যূনতম চিকিৎসা প্রদান করা হয়নি এবং গুমের শিকার ও জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসায় কিছু চিকিৎসক অনাগ্রহ প্রদর্শন করেছেন।

বাংলাদেশ গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য ডা. নাবিলা ইদ্রিস জানান, গুমের প্রকৃত চিত্র এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়নি এবং আক্রান্তরা এখনও ট্রমায় ভুগছেন। আর রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াজির চেয়ারম্যান ডা. আনিস আহমেদ বলেন, রাষ্ট্র নিপীড়নের প্রভাব শুধুমাত্র ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার পরিবার ও আশপাশের মানুষদের উপরও পড়ে, যেখানে বিশেষত শিশুরা নানা ধরনের ট্রমায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের জন্য আর্ট থেরাপি কার্যকর হতে পারে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জালাল উদ্দিন বলেন, গুমের শিকাররা যেন তাদের পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয়ে ওঠে, সে জন্য সমাজের সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন এবং মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া উচিত।

এছাড়া কর্মশালায় গুমের ঘটনাগুলোকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার ও সমাজের সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

গুম থেকে বেঁচে ফিরে আসা মাইকেল চাকমা, লেফট্যানেন্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান, এবং ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান তাদের গুমের ভয়াবহ ও অশ্রুসিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তারা জানান, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার—বিশেষ করে মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের অপেক্ষার যন্ত্রণা অপরিসীম। অনিশ্চিত জীবন-যাপনের কারণে পারিবারিক সম্পর্কগুলো মানসিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। স্রষ্টার উপর বিশ্বাস ও ধর্মীয় চর্চা তাদের বেঁচে থাকার আশা জুগিয়েছে।

গুম থেকে ফিরে এসে পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও পুনঃসম্পর্ক স্থাপন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বিশেষ করে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উপর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবাররা ভয় ও শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের চরম হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ও সুযোগসন্ধানীদের এখন জাতির কাছে মানবাধিকার কর্মী বা দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখা দায়সারা ও উপহাসমূলক।

গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গ ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে তারা এখনও মামলার জন্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাই গুমের বিচার ও শিকার ব্যক্তিদের পুনর্বাসন বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়। পাশাপাশি, জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনাগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার ও সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (সিএডিএফ), ইউকের চেয়ারম্যান ডা. মুসলেউদ্দিন ফরিদ বলেন, সিএডিএফ স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গবেষণা সহ গুমের শিকার ব্যক্তি, পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ সিলেট ও চট্টগ্রামের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিদেশি চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে এবং এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

ঘন ঘন জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনা কেন পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আছে?

জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলো পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঐতিহাসিক সত্যতা ও দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হবে।

গুমের ঘটনা কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?

গুম বলতে কারাবন্দি বা পুলিশি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের আইনবহির্ভূতভাবে নিখোঁজ করার ঘটনা বোঝানো হয়। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর একটি রূপ, যার ইতিহাস জানানো গুরুত্বপূর্ণ।

পাঠ্যপুস্তকে এই ঘটনা সংযুক্ত করলে কী ধরনের পরিবর্তন আশা করা যায়?

এমন সংযোজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সত্যবোধ, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্নয়নে সাহায্য করবে।

কে বা কোন প্রতিষ্ঠান এই আহ্বান জানাচ্ছে?

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জুলাই যোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহ পাঠ্যপুস্তকে এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে।

পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন কতটা সময়সাপেক্ষ এবং কার্যকর?

সরকারি ও শিক্ষাবোর্ডের নীতি নির্ধারণ, পঠন-পাঠনের প্রক্রিয়া অনুসারে এটি কিছু সময় নিতে পারে, তবে তা দ্রুত করার মাধ্যমে দেশের ইতিহাসের সঠিক ধারণা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

উপসংহার

জুলাই বিপ্লব ও গুমের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমোচনীয় অংশ, যা পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করা অতীব জরুরি। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা জানতে পারবে। এর মাধ্যমে দেশের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটবে এবং সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত এই ঐতিহাসিক বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top