চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এবার মূল ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন।

বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বেলা আড়াইটার দিকে নগরের মেহেদীবাগ এলাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের পাশে অবস্থিত বাদশা মিয়া সড়কে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এর ফলে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
বেলা দুইটা থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ইনস্টিটিউটের ফটকের সামনে জড়ো হয়ে অবস্থান নেন। পরে তাঁরা নগরের বাদশা মিয়া সড়ক অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
বিক্ষোভকালে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন, যেমন: ‘দাবি মোদের একটাই, চারুকলা ক্যাম্পাসে চাই’, ‘দাবি মোদের একটাই, ২৩০০ একরে জায়গা চাই’, এবং ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, চারুকলা মুক্তি পাক’।
এর আগে, মঙ্গলবার শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। মূল ক্যাম্পাসে ফেরার দাবিতে এটি গত দুই বছরে তাঁদের তৃতীয় দফা আন্দোলন।
আন্দোলন নিয়ে জানতে চাইলে চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী খন্দকার মাসরুল আল ফাহিম বলেন, “চারুকলা স্থানান্তর ও বৈষম্যের পেছনে দায়ী ইনস্টিটিউটের শিক্ষকেরা। তাঁদের সদিচ্ছার অভাবের কারণে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমরা মূল ক্যাম্পাসে ফিরতে চাই।”
তিনি আরও জানান, মূল ক্যাম্পাসে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আপাতত সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে।
পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, “শিক্ষার্থীদের মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবির বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় প্রয়োজন। আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি।”
বারবার আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। মূল ক্যাম্পাসে ফেরার দাবিতে গত দুই বছরে এটি তাঁদের তৃতীয় দফা আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাঁরা, যা মূলত শিক্ষকদের সদিচ্ছার অভাবের ফল।
এমনকি তাঁরা প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগানো থেকে শুরু করে সড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তাঁদের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হলেও শিক্ষার্থীরা দ্রুত সমস্যার সমাধান চান এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস নগর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীতে অবস্থিত। ২০১০ সালে চবি চারুকলা বিভাগ ও চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে একীভূত করার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে ইনস্টিটিউটটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে শিক্ষার্থীদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে শিক্ষার্থীরা ১১ দফা দাবিতে ক্লাস বর্জন করেন। এর পর থেকে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন এবং একপর্যায়ে নগরের ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের এক দফা দাবি জানান।
১৬ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা প্রশাসন দাবি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ইনস্টিটিউটের মূল ফটকে তালা লাগান। এরপর কর্তৃপক্ষ সাত দিনের সময় চাইলে শিক্ষার্থীরা শর্ত সাপেক্ষে ২৩ জানুয়ারি ক্লাসে ফেরেন। কিন্তু দাবি পূরণ না হওয়ায় ৩১ জানুয়ারি তাঁরা আবারও অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্লাসে ফেরার দাবি তুললেও, ১ ফেব্রুয়ারি রাতে চারুকলা ইনস্টিটিউটের হোস্টেলে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডি যৌথভাবে তল্লাশি অভিযান চালায়। এ ঘটনায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চারুকলা ইনস্টিটিউটের সশরীর শ্রেণি কার্যক্রম এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ইনস্টিটিউট ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ ভবন সংস্কারের কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে মূল ক্যাম্পাসেই বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন।
৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে হামলা চালায় নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও জোরালো হলেও প্রশাসন তাঁদের দাবি পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
একপর্যায়ে সেশনজট কমানোর স্বার্থে গত বছরের ৩ মে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাঁদের দাবি পূরণ না হওয়ায় আজ থেকে আবার নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন তাঁরা।
কেন চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবি করা হচ্ছে?
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নগরীর বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউটের অবস্থান ও অবকাঠামো মূল ক্যাম্পাসের তুলনায় অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্যের শিকার। এতে তাঁরা শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁরা মূল ক্যাম্পাসে ফেরার মাধ্যমে সমান সুযোগ এবং সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে চান।
এ আন্দোলনের পেছনে কী কী ঘটনা প্রভাব ফেলেছে?
শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়া।
২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর ইনস্টিটিউটের ফটকে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন।
শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের হামলা।
বারবার দাবি উত্থাপনের পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর সমাধান না পাওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবস্থান কী?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে শিক্ষার্থীদের মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবি যথার্থ, তবে এটি বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে।
আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি কী?
শিক্ষার্থীরা নগরীর বাদশা মিয়া সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এর আগের আন্দোলনের ফলাফল কী ছিল?
২০২২ সালের আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে সময় দিয়ে ক্লাসে ফিরেছিলেন। তবে দাবি পূরণ না হওয়ায় তাঁরা আবার আন্দোলনে নামেন। সেশনজট কমাতে গত বছর মে মাসে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন আবার সড়ক অবরোধসহ নতুন কর্মসূচি শুরু করেছেন।
উপসংহার
উপসংহার হিসেবে বলা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন। অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য এবং শারীরিক অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে তাঁরা মূল ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে চান। যদিও প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে বাস্তবায়নের জন্য আরও সময় প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন এবং দাবি পূরণের জন্য আরও কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এখন দেখার বিষয় হবে, কতটুকু দ্রুত প্রশাসন এই সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে সক্ষম হয়।




