কারবালা: সত্যের অবিনাশী চেতনা

কারবালা: সত্যের অবিনাশী চেতনা

“কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে মাতম ও মর্সিয়া অন্যতম।”

‘আশুরা’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘আশারা’ থেকে, যার অর্থ ‘দশ’। অর্থাৎ, হিজরি বছরের প্রথম মাস মুহাররমের দশম দিনকে ‘আশুরা’ বলা হয়। পবিত্র আশুরা মুসলিম ঐতিহ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ, বরকতময় ও স্মরণীয় দিন হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামপূর্ব যুগেও এই দিনটি বিশেষ মর্যাদায় পালিত হতো।

এই দিনেই ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক অধ্যায় রচিত হয়েছিল কারবালার প্রান্তরে—যেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে শহীদ হন। পবিত্র আশুরা কেবল কারবালার ঘটনা নয়, বরং এটি আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।

তার মধ্যে অন্যতম একটি ঘটনা হলো ফেরাউন থেকে হজরত মুসা (আ.)-এর মুক্তিলাভ, যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে তাওহিদের বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরাউন একগুঁয়েভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে নিজেকেই ‘সর্বোচ্চ প্রভু’ বলে ঘোষণা দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“অতঃপর সে সকলকে একত্র করল এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা করল— বলল, ‘আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’ ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে আখেরাত ও দুনিয়ার শাস্তিতে পাকড়াও করলেন।”
(সূরা নাযিয়াত : ২৩-২৫)

এরপর থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের ওপর শুরু হয় ফেরাউনের চরম জুলুম ও নির্যাতন। এই নিপীড়নের মুখে আল্লাহর নির্দেশে হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে দেশত্যাগের আদেশ দেন। একপর্যায়ে তাঁরা এসে পৌঁছান লোহিত সাগরের তীরে। তখন তারা পড়ে যায় এক ভয়াবহ সংকটে— সামনে বিশাল সাগর, আর পেছনে ধাওয়া করছে ফেরাউনের সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী।

এই চরম মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে হজরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি দিয়ে সাগরে আঘাত করেন। অলৌকিকভাবে সাগর দ্বিখণ্ডিত হয়ে একটি শুকনো পথ তৈরি হয়। তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নিরাপদে সাগর পাড়ি দেন। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে ফেরাউনের সৈন্যবাহিনীও সেই পথ ধরে সাগরে প্রবেশ করে। কিন্তু সাগরের মাঝপথে পৌঁছাতেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে সাগর, এবং ফেরাউনসহ তার পুরো বাহিনী সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

ধ্বংসের ঠিক আগমুহূর্তে ফেরাউন তার বিভ্রান্তি বুঝতে পেরে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তখন আর তা কবুল হয়নি, কারণ মৃত্যুর সময় ঈমান গ্রহণ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এই ঘটনার উল্লেখ করে ইরশাদ করেন:

“আমি বনি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। ফেরাউন ও তার বাহিনী জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে, যখন তারা ডুবে মারা যাচ্ছিল, তখন বলল: ‘আমি বিশ্বাস করলাম, বনি ইসরাইল যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’”

আশুরার সর্বাধিক স্মরণীয় ও মর্মান্তিক ঘটনা হলো কারবালার বিপ্লব। ৬১ হিজরির ১০ মুহাররম, কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) স্বপরিবারে ৭২ জন সঙ্গীসহ শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর এই ত্যাগ ছিল হক, ইনসাফ ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা যুগে যুগে সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামীদের জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মহত্তম আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধর্মীয় আচার-কুসংস্কার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাতম, মর্সিয়া পাঠ এবং শোক পালন করতে গিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করা, রক্তাক্ত করা, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি শরিয়তবিরোধী কাজও রয়েছে। এসব আচরণ ইসলামের মূল আদর্শের পরিপন্থী।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করে গেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন:
“যে ব্যক্তি শোকে গালে চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহেলি যুগের মতো আহাজারি করে— সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
(সহিহ বুখারি : হাদিস ১২৯৭)

আশুরার দিন মুসলিম উম্মাহর জন্য যেমন শোক ও বেদনার বার্তা বয়ে আনে, তেমনি এটি সত্য ও ন্যায়ের পথে আপসহীন অবস্থান নেওয়ার অদম্য চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। হজরত হোসাইন (রা.) ছিলেন দৃঢ়চিত্ত, ঈমানদার, ন্যায়পরায়ণ ও আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক। খেলাফতে রাশেদার পুনর্জাগরণের প্রত্যয় নিয়ে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল অবস্থান নিয়েছিলেন।

তিনি বলতেন, “লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যু শ্রেয়।”
আশুরা প্রতি বছর ফিরে আসে আমাদের হৃদয়ে ত্যাগ, সাহস, ঈমান ও আদর্শে জাগ্রত করার জন্য। হোসাইনি আদর্শই আমাদের শিক্ষা দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম
#কারবালা #আশুরা #ইসলাম

ঘন ঘন জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

কারবালার ঘটনা কী এবং কখন ঘটেছিল?

কারবালার ঘটনা ৬১ হিজরি, ১০ মুহাররম (আশুরা) তারিখে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত হয়। এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) ও তাঁর ৭২ জন সাথী ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শহীদ হন।

হজরত হোসাইন (রা.) কার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং কেন?

হজরত হোসাইন (রা.) ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার অন্যায়, জুলুম ও ইসলামবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি খেলাফতে রাশেদার আদর্শ রক্ষায় আপসহীন থেকে সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মোৎসর্গ করেন।

কারবালার শিক্ষা কী?

কারবালা আমাদের শিক্ষা দেয়— সত্যের পথে অবিচল থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থাকা এবং ঈমান ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। এটি মুসলিম জাতির জন্য নৈতিকতা, সাহস ও আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত।

আশুরা উপলক্ষে শরিয়তসম্মত করণীয় কী?

আশুরার দিনে নফল রোজা রাখা, দোয়া, ইবাদত ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উত্তম। বিদআত ও কুসংস্কার থেকে বিরত থেকে হজরত হোসাইন (রা.)-এর আদর্শ স্মরণ করাই হলো প্রকৃত অনুসরণ।

শরিয়তের দৃষ্টিতে মাতম ও শরীর আঘাত করার বিধান কী?

ইসলাম অনুযায়ী, শোক প্রকাশের নামে গালে চপেটাঘাত, শরীর রক্তাক্ত করা, কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি জাহেলি যুগের কুসংস্কার এবং হারাম। রাসুল (সা.) এসব কাজ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

উপসংহার

কারবালার ঘটনা শুধুমাত্র ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায় নয়, বরং এটি সত্য, ন্যায় ও আদর্শের পথে দৃঢ়চেতা অবস্থানের এক চিরন্তন নিদর্শন। হজরত হোসাইন (রা.) তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, অন্যায়ের কাছে মাথানত নয়— বরং ন্যায় ও ঈমানের পথে শহীদ হওয়াই প্রকৃত বিজয়। আশুরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আদর্শের জন্য ত্যাগ কখনও বৃথা যায় না। এদিন আমাদের উচিত হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, কুসংস্কার ও বিদআত পরিহার করে শরিয়তসম্মতভাবে দিনটি পালন করা এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকা। কারবালার চেতনা হোক আমাদের জীবনের প্রেরণা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top