এনসিটিবি কি কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র, প্রশ্ন টিআইবির

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, আদিবাসী পরিচয়ের ব্যাখ্যাটি যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তা না জানা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর পাশাপাশি, কোনো ধরনের যৌক্তিক পর্যালোচনা বা বিবেচনা ছাড়াই এক পক্ষের দাবি মেনে নেওয়া, পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের একটি উদাহরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে নিজেকে কার্যত কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) টিআইবি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, এনসিটিবির এই সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তীতে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা বৈষম্যমুক্ত ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার চেতনার সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।

সংগঠনটি এনসিটিবির কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রতিষ্ঠানটিকে কর্তৃত্ববাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এনসিটিবি দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন সত্ত্বেও, তাদের ভেতরে কর্তৃত্ববাদী চর্চার সংস্কৃতি এখনও বহাল রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ পরিচয় ব্যবহার করা যাবে না—এই অযৌক্তিক ও উদ্ভট তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিল কর্তৃত্ববাদী সরকার। এর পেছনে ছিল সেই স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন, যারা আদিবাসী অধিকার হরণের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে আড়াল করতে চেয়েছিল। তারা বিশ্ববাসীকে এই ভুল বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, বাংলাদেশে আদিবাসী বলে কোনো জনগোষ্ঠী নেই।

তিনি বলেন, এই মহলটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বীকার করতে চায়নি যে আদিবাসী পরিচয়ের মানদণ্ড কোনো জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কতদিন ধরে বসবাসের উপর নির্ভর করে না। তারা মানতে চায়নি যে আদিবাসী হলেন সেই জনগোষ্ঠী, যারা মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে থেকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রথাগত ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-নির্ভর জীবনধারা বজায় রেখে নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচিত করতে চান।

তিনি আরও বলেন, আদিবাসী পরিচয়ের এই ব্যাখ্যা যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তা না জানা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর পাশাপাশি, কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই এক পক্ষের আবদারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের স্পষ্ট প্রতিফলন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও উল্লেখ করেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই। তবে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই বিবৃতিতে সচেতনভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিচয় হিসেবে ‘আদিবাসী’ শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে আদিবাসী পরিচয় সম্পর্কিত শব্দচয়নের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

এনসিটিবি কি কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র? প্রশ্ন টিআইবির

নিম্নে এ সংক্রান্ত ৫টি সাধারণ প্রশ্নোত্তর উপস্থাপন করা হলো:

টিআইবি কেন এনসিটিবিকে কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বলে অভিহিত করেছে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাদ দেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে কার্যত কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে প্রমাণ করেছে। তাদের মতে, এনসিটিবি কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা ফ্যাসিবাদী আচরণের উদাহরণ।

‘আদিবাসী’ শব্দটি পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়ার পেছনে কী কারণ দেখানো হয়েছে?

সরকারি পক্ষ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংবেদনশীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে টিআইবির মতে, এই পদক্ষেপ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারকে অস্বীকার করার এবং তাদের দাবি ধামাচাপা দেওয়ার একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রচেষ্টা।

টিআইবি এনসিটিবির এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কী মন্তব্য করেছে?

টিআইবি বলেছে, এনসিটিবির সিদ্ধান্ত বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে প্রতারণার শামিল। সংস্থাটি দাবি করেছে, এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত এবং সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতির প্রতিফলন।

টিআইবি কি এনসিটিবির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে?

হ্যাঁ, টিআইবি এনসিটিবির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকে কর্তৃত্ববাদের দোসরমুক্ত করে পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।

এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কী প্রভাব ফেলে?

টিআইবির মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈধ পরিচয়কে অস্বীকার করা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি জাতিগত বৈচিত্র্য ও মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে।

উপসংহার

এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ অপসারণের সিদ্ধান্ত এবং তা ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় গভীর চিন্তার জন্ম দিয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং কর্তৃত্ববাদী চর্চার প্রতিফলন বলে অভিহিত করেছে।

এটি শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদার প্রতি উপেক্ষা নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

তাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যমুক্ত এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এনসিটিবির পুনর্গঠন এবং নীতি সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। জনগণের বৈচিত্র্য ও অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা এবং নৈতিকতার প্রশ্নে এ সিদ্ধান্ত যথাযথ পর্যালোচনা করা উচিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top