অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি : টাকা না দিলে তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার হুমকি

অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি : টাকা না দিলে তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার হুমকি

যদিও নাটোরের রেজাউল একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত, তবে যশোরের হাবুল ও আলমাচ দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে মোবাইল ফোনের দোকানে মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন। তারা প্রতিষ্ঠানের কেরানি ও অধ্যক্ষের সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে হাজিরা খাতায় নিয়মিত উপস্থিত হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন।

নাটোরের এম কে কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স কোর্সের প্রভাষক মো. রেজাউল করিম দুই বছর আগে নিয়োগ পান। নিয়োগের সময় কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম শিমুল। তবে এরও আগে থেকে তিনি বড়াইগ্রামের বনপাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতে রেজাউলের আগ্রহ কম। কারণ হিসেবে জানা গেছে, সেখানে বেতন কম এবং শিশু শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে শোরগোল সামাল দিতে হয়। ফলে শ্রেণিকক্ষে তার উপস্থিতিও অনিয়মিত। অন্যদিকে, এম কে কলেজের অনার্স শাখা এখনো এমপিওভুক্ত নয়। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষও তাকে নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার তাগিদ দেন না।

রেজাউল করিম ক্ষমতাসীন এমপি ও তৎকালীন পরিচালনা কমিটির সভাপতির আত্মীয় হওয়ায় গত বছরের ৫ আগস্টের আগে তাকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া কঠিন ছিল। তিনি অন্যদেরকেও তেমন গুরুত্ব দিতেন না। তবে জুলাইয়ে কলেজ পরিচালনায় পরিবর্তন আসার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার উপস্থিতি কিছুটা নিয়মিত হয়।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সম্ভাবনার খবর প্রকাশের পর থেকে এম কে কলেজে রেজাউলের আগ্রহ বাড়তে দেখা গেছে। তিনি এখন কলেজের হাজিরা খাতা ও প্রশাসনিক খোঁজখবরও নিচ্ছেন। দৈনিক ‘আমাদের বার্তা’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, নাটোরের রেজাউল করিম বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকলেও, যশোরের হাবুল ও আলমাচ বহু বছর ধরে রাজধানীর মোবাইল ফোনের দোকানে মেকানিক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা কেবল কেরানি ও অধ্যক্ষের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রেখে হাজিরা খাতায় নিজেদের উপস্থিত রাখছেন।

এছাড়া টাঙ্গাইলের হাবিবুর রহমান, খুলনার অলিউল্লাহ, শরীয়তপুরের ফরিদ হোসেন এবং বরগুনার আবু বকর হাওলাদার বহু বছর আগে বিদেশ, বিশেষ করে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু গত ২ জুলাই অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষকদের মানবিক বিবেচনায় এমপিওভুক্তির উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তারা আবার নিজেদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছেন।

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নন-এমপিও শিক্ষক ফোরামের গ্রুপে আলোচনার মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, একটি শিক্ষক ফেডারেশন নাকি এমপিওভুক্তির জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করছে। এই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে গুজব রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এমপিও তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঘুষ দিতে হচ্ছে। একাধিক ফেডারেশন নেতাকে এই ঘুষ বণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি অনেকে হুমকি দিচ্ছেন—যারা অর্থ দেবেন না, তাদের নাম তালিকায় ওঠানো হবে না। সেই তালিকায় নাম না থাকলে ভবিষ্যতে সরকারিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ারও সুযোগ থাকবে না বলে দাবি করছেন তারা।

দেশজুড়ে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের নন-এমপিও শিক্ষকদের সরকারি বেতন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তির (এমপিওভুক্তি) উদ্যোগকে ঘিরে মাঠে নেমেছেন অনেক আগের অনিয়মিত শিক্ষকরা। যাঁরা দীর্ঘদিন কলেজে উপস্থিত ছিলেন না, অন্য পেশা বা ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন—এমন শিক্ষকরাই এখন তালিকায় নাম তোলার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন।

অপরদিকে, যারা কলেজ ফান্ড থেকে সামান্য সম্মানী নিয়ে বছরের পর বছর নিয়মিত পাঠদান করে গেছেন, তারা এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের অনেকে ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’-কে জানান, কলেজের সাবেক সভাপতির আত্মীয়-স্বজন ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন যোগাযোগ না রেখেও এখন এমপিওভুক্তির খবরে ফের সক্রিয় হচ্ছেন। বর্তমানে রাজনীতির হাওয়া সভাপতি ও তাদের অনুকূলে বইছে বলেই এই পুনরাবির্ভাব—এমনটাই মনে করছেন তারা।

নির্দলীয়, নিরেট ও পরিশ্রমী শিক্ষকরা এই পরিস্থিতিতে শঙ্কিত। তাদের আশঙ্কা, চাঁদাবাজির চাপে প্রকৃত কর্মরত শিক্ষকরা বঞ্চিত হতে পারেন, আর সুবিধাভোগী গোষ্ঠী অগ্রাধিকার পেতে পারে। তারা দাবি তুলেছেন, শিক্ষা অধিদপ্তরের উচিত শুধুমাত্র কর্মরত শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করা, যাতে অতীতের অনিয়মিত ও প্রভাবশালী আত্মীয়রা তালিকার শীর্ষে উঠে না আসেন।

এমপিওভুক্তি নিয়ে কারও আগ্রহ, কারও অনীহা

যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষকরা ৩৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি কোষাগার থেকে বঞ্চিত থাকার পর এমপিওভুক্তির স্বপ্নে আশাবাদী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত বরাদ্দ চিঠির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন—ঠিক তখনই উঠে এসেছে ভিন্ন এক চিত্র। কেউ কেউ এমপিওভুক্ত না হওয়ার দিকেও সক্রিয়ভাবে এগোচ্ছেন।

‘আমাদের বার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার তেজগাঁও কলেজসহ কয়েকটি বড় ও অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল কলেজে—যাদের নিজস্ব ফান্ডে কয়েকশ কোটি টাকা রয়েছে—সেখানে অনেক অধ্যক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষক এমপিওভুক্তির বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন।

তেজগাঁও কলেজের একজন নন-এমপিও অনার্স শিক্ষক মনজুরুল কবীর জানান, সম্প্রতি ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় তেজগাঁও কলেজসহ আশপাশের আরও কয়েকটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা অনুযায়ী, তারা বর্তমানে কলেজ ফান্ড থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত হলে তাদের সরকারি বেতন স্কেল হবে ২২ হাজার টাকা, সঙ্গে থাকবে নামমাত্র বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা।

এছাড়া এমপিওভুক্তির পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে, আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নজরদারিও বাড়বে। এমপিওর বাইরে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ ধরা পড়লে সেটি অডিট আপত্তির মুখে পড়বে। এতে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

চার বছর আগে ঢাকার তেজগাঁও কলেজে অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবিতে একটি প্রতিনিধি দল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আবদুর রশীদের সঙ্গে দেখা করে। প্রতিনিধি দলে থাকা মনজুরুল কবীর জানান, তখন অধ্যক্ষ রশীদ স্পষ্টভাবে বলেন, তিনি ও তার সিনিয়র সহকর্মীরা এমপিওভুক্তির বিপক্ষে। কারণ, এতে শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। রশীদের মতে, তার কলেজের একজন অনার্স অধ্যাপক মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতন-ভাতা পান, যা এমপিওভুক্ত হলে অনেক কমে আসবে।

অধ্যক্ষ বদল, অনিয়ম একই

আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ অবসরে গেলে তারই ছোট ভাই, উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে অবসরপ্রাপ্ত মো. হারুন-অর-রশিদ অধ্যক্ষ হিসেবে তেজগাঁও কলেজে যোগ দেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের পর তিনি পলাতক।

তদন্তে উঠে আসে, অধ্যক্ষ হারুন-অর-রশিদ বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করতেন। এর মধ্যে ছিল নিয়োগ পরীক্ষার হল ভাড়া বাবদ আয়, বিভিন্ন অজুহাতে আদায়কৃত ফি এবং অনার্স শিক্ষকদের ‘সিটি অ্যালাউন্স’ নামে একটি অস্পষ্ট খাত থেকে কোটি টাকার উত্তোলন।

কর্মরত নন-এমপিও শিক্ষকের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বেসরকারি কলেজ শাখার কর্মকর্তারা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না, দেশের ঠিক কতজন নন-এমপিও অনার্স শিক্ষক বর্তমানে কর্মরত। অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, তারা সদ্য এই শাখায় নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট সংখ্যা তাদের জানা নেই। তবে তাদের একটি আনুমানিক ধারণা অনুযায়ী:

কলেজ সংখ্যা: ১,০০০-এর বেশি

শিক্ষক সংখ্যা: আনুমানিক ৩,৫০০

তবে নিয়োগপ্রাপ্তের সংখ্যা: ৫,০০০-এরও বেশি

প্রকৃত নিয়মিত কর্মরত শিক্ষক: আনুমানিক ২,০০০

বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসাইনের তথ্যমতে, বর্তমানে ৪৯৫টি কলেজে প্রায় ৩,৫০০ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন।

জাতীয় পর্যায়ের বৈঠকে অর্থ বরাদ্দের আলোচনা
২০২৪ সালের ২ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে কর্মরত ৩,৫০০ শিক্ষকের জন্য বার্ষিক ১১২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রস্তাবিত বরাদ্দের বিষয়টি আলোচিত হয়।

তালিকাভুক্তির নামে টাকা আদায়ের অভিযোগ
এমপিওভুক্তির এই সম্ভাবনা ঘিরে দেখা দিয়েছে আরেকটি উদ্বেগজনক প্রবণতা—তালিকায় নাম তোলার নামে চাঁদাবাজি। বরগুনার পাথরঘাটা কলেজের এক অনার্স শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের বার্তাকে জানান, একটি শিক্ষক সমিতি তালিকা তৈরির কাজ করছে এবং সেখানে নাম তোলার জন্য অর্থ দাবি করা হচ্ছে। বেশি টাকা দিলে তালিকার ওপরের দিকে নাম রাখা হচ্ছে, আর কম টাকা দিলে নিচে। এমনকি কিছু কলেজে অধ্যক্ষরাও নিজেদের পছন্দমতো শিক্ষকদের তালিকায় অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে অনেকে বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-ভান্ডার (ডেটাবেইস) ব্যবহার করে গত ১০ বছরের বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ও পরীক্ষার্থীর উপস্থিতি বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত কর্মরত শিক্ষকদের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব।

চূড়ান্ত দাবি: স্বচ্ছ ও কেন্দ্রীয় তালিকা
বহু নিয়মিত শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের দাবি—এমপিওভুক্তির আগে শিক্ষকদের একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও কেন্দ্রীয় তালিকা তৈরি করা জরুরি, যাতে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও বছরের পর বছর অনুপস্থিত, বিদেশে অবস্থানকারী বা ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সুযোগ না পান।

তাদের আহ্বান, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত কর্মরতদের তালিকা প্রস্তুত করা হোক এবং রাজনৈতিক বিবেচনা, আত্মীয়তা বা আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে যেন তালিকা প্রভাবিত না হয়।

দৈনিক আমাদের বার্তা ডেস্ক | অনুসন্ধান প্রতিবেদন

পাথরঘাটার লেমুয়ার সৈয়দ ফজলুল হক কলেজের অনার্স শাখায় কর্মরত অনেক শিক্ষক এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন সনদ পাননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের তদবিরে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার ব্যত্যয়। অথচ কলেজটির একাদশ-দ্বাদশ ও ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত ও নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।

চাঁদার নামে ৫২ লাখ টাকা লোপাট!
প্রায় এক দশক আগে অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর এবং একটি শিক্ষক ফেডারেশন—সব পক্ষকে “ম্যানেজ” করার কথা বলে প্রায় ৫২ লাখ টাকা তোলা হয়। ওই অর্থের পুরোটাই জমা হয় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায়।

দুইজন শিক্ষক নেতা দাবি করেন, এই অর্থের মধ্যে ১০ লাখ টাকা একজন আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছিল এমপিওভুক্তির আদেশ আদায়ের জন্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, যেহেতু কোনো মামলা করে সিদ্ধান্ত আনা সম্ভব হয়নি, তাই তিনি কোনো টাকা গ্রহণ করেননি।

এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষকরা বিষয়টি বুঝতে পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেন, যাতে সংগঠনের অনুমোদন ছাড়া অর্থ উত্তোলন না হয়। কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজারের সহায়তায় সম্পূর্ণ অর্থ তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তৎকালীন এক নেতা যিনি পরে কলেজ সরকারিকরণের সুবিধা পান, তিনি এখনো অধরা। আরেক নেতা, যার নামের প্রথম অক্ষর “ন”, কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে সম্প্রতি আবার তৎপর হয়েছেন।
‘এসব মিথ্যা কথা’ — প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশন সভাপতি
অভিযোগ অস্বীকার করে ফেডারেশন সভাপতি নেকবর হোসাইন বলেন, “আমরা তো কখনোই এসব কাজে জড়িত নই। কারা করছে, আমরা জানি না। অনেকেই মিথ্যা কথা ছড়ায়। যখন কোনো ভালো উদ্যোগ হয়, তখন এ ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করাই স্বাভাবিক।”
মন্ত্রণালয়ের অবস্থান: এখনো কোনো তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়নি
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, এখনো এমপিওর জন্য অনার্স শিক্ষকদের কোনো ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়নি। কোনো সমিতি বা ফেডারেশন তথ্য জমা দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
তালিকা প্রণয়নে ডিসির ভূমিকা কি কার্যকর?
পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, ডিসিদের মাধ্যমে কোনো তালিকা তৈরির দায়িত্ব গেলে তা আসলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের হাতেই যায়। অনেক ক্ষেত্রে দালালচক্র ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে আর্থিক যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। তাই এমপিও তালিকায় প্রবাসে অবস্থানকারী, প্রাথমিক শিক্ষক পদে কর্মরত বা কলেজে অনুপস্থিতদের নাম ওঠার ঝুঁকি থেকে যায়।
একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, “শুধু ডিসিদের দিলে হবে না, জেলা পর্যায়ে প্রকৃত যাচাই যারা করবেন তাদেরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে আবার প্রভাবশালীরা তালিকায় ঢুকে যাবেন।”
প্রস্তাব: স্বচ্ছ যাচাইয়ে ঝটিকা পরিদর্শন
সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, “সরকার অনেক দেরিতে হলেও ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যদি প্রকৃত নিয়মিত শিক্ষকরা বাদ পড়ে যান, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ অনৈতিক। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রতি জেলার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও ৯ জন আঞ্চলিক পরিচালককে ঝটিকা পরিদর্শনের দায়িত্ব দিলে, হাজিরা খাতা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেই বাস্তবচিত্র বোঝা সম্ভব হবে।”
সখ্যার গরমিল এখনো স্পষ্ট নয়
বর্তমানে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যমতে:
লেজ সংখ্যা: আনুমানিক ৪০০–৫০০
নিয়মিত কর্মরত অনার্স শিক্ষক: প্রায় ২,০০০
নিয়োগপ্রাপ্ত অনার্স শিক্ষক: ৫,০০০-এর বেশি
ফেডারেশনের দাবিকৃত সংখ্যা: ৪৯৫টি কলেজে ৩,৫০০ শিক্ষক
বরাদ্দের প্রস্তাবিত বাজেট: ১১২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা/বছর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব
শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও পরীক্ষার্থী ডাটাবেইস বিশ্লেষণ করলেই জানা যাবে, কোন বিষয়ের শিক্ষক কোন বছর থেকে কার্যকরভাবে কর্মরত। কারণ, অনেক কলেজে বিষয় খোলা থাকলেও শিক্ষার্থী না থাকায় বিভাগ বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু শিক্ষক ‘কাগজে-কলমে’ রয়ে গেছেন।
সতর্ক বার্তা:
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান না নিলে এই দুর্লভ সুযোগও ক্ষমতাবান ও ধূর্ত চক্রের হাতে চলে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টরা।
আরও তথ্য ও ভিডিও বিশ্লেষণের জন্য দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল আইকনে ক্লিক করুন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়ায় কী হচ্ছে?

বর্তমানে সরকার অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের মানবিক বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রায় ৩,৫০০ শিক্ষকের এমপিওভুক্তির প্রস্তাবসহ বছরে ১১২ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে।

তালিকাভুক্তির জন্য কী চাঁদা দাবি করা হচ্ছে?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছু শিক্ষক ফেডারেশন ও সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, এমপিও তালিকায় নাম তোলার জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা দাবি করা হচ্ছে। বেশি টাকা দিলে তালিকায় ওপরের দিকে নাম দেওয়া হচ্ছে, কম দিলে নিচে বা বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

এই চাঁদার পরিমাণ কত এবং কীভাবে তোলা হচ্ছে?

প্রায় এক দশক আগে একটি ফেডারেশন ৫২ লাখ টাকার মতো তোলার দাবি করেছিল মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর ‘ম্যানেজ’ এবং মামলা চালানোর কথা বলে। অভিযোগ রয়েছে, টাকা তোলার সময় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় একাউন্ট ব্যবহার করা হয়, এবং পরে অনুমতি ছাড়াই টাকা তুলে নেওয়া হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কি এসব তালিকা গ্রহণ করছে?

না, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্পষ্ট করে জানিয়েছেন—তারা এখনো এমপিওর জন্য কোনো তথ্য সংগ্রহ শুরু করেনি এবং কোনো ফেডারেশনের তৈরি তালিকা সরকারিভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রকৃত নিয়মিত শিক্ষকদের নাম কীভাবে নির্ধারণ করা যাবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও পরীক্ষার্থীর রেকর্ড এবং কলেজের হাজিরা খাতা যাচাই করে প্রকৃত নিয়মিত শিক্ষকদের শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বা আঞ্চলিক পরিচালকদের মাধ্যমে সরেজমিনে তদন্তের মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে।

উপসংহার

অনার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি নিয়ে সরকারের উদ্যোগ একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ লেনদেন, রাজনৈতিক প্রভাব, ভূয়া নিয়োগ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক তালিকা তৈরির মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষকদের বঞ্চিত করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনই সময়—সরকার যেন সুনির্দিষ্ট ও নিরপেক্ষ উপায়ে কেবলমাত্র নিয়মিত, যোগ্য এবং নিবন্ধিত শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করে। নয়তো এই মহৎ উদ্যোগও সাধারণ শিক্ষকদের হতাশা ও ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠবে। বাস্তব যাচাই ও তদারকি ছাড়া স্বচ্ছ এমপিওভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top